আব্বাসীয় শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক আলোচনা করো।
উত্তর :- আব্বাসীয়দের শাসনব্যবস্থা : আমির মোয়াবিয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া খলিফারা যে শাসনব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন, আব্বাসীয় যুগে তা পূর্ণতা লাভ করেছিল।আব্বাসীয় শাসনামলে শাসন বিভাগের সর্বক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংস্কার সাধিত হয়েছিল। উমাইয়া খিলাফতের মতো আব্বাসীয় খিলাফতও মূলত রাজতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে আব্বাসীয় খলিফাগণ উমাইয়াদের মতো সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী নীতি পরিহার করেছিলেন। উমাইয়া যুগে উচ্চপদে কেবল আরবরাই নিয়োগ হত। কিন্তু আব্বাসীয় খলিফারা এই বৈষম্য পরিহার করে যে কোনো উপযুক্ত ব্যক্তি এমনকি অমুসলিমকেও রাজকার্যে নিয়োগ করতেন।
আবাসীয় শাসনব্যবস্থা মোটের ওপর দু-ভাগে বিভক্ত ছিল—(১) কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা (২) প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা।
খলিফা সর্বময় কর্তা : আব্বাসীয় যুগের খলিফা ছিলেন সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তা। তিনি একাধারে সর্বোচ্চ শাসনকর্তা এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় নেতা। তিনি প্রশাসনের জন্য উজির, বিচারের জন্য কাজী এবং সামরিক ক্ষেত্রে সেনাপতি নিযুক্ত করতেন। খলিফা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেও তিনি সাধারণত স্বেচ্ছাচারী হতেন না।
উজির (প্রধানমন্ত্রী) : খলিফার পরবর্তী উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন শাসনকর্তা ছিলেন উজির। তিনি সাধারণত খলিফার বেসামরিক দায়িত্ব পালন করতেন। অনেক সময় দেখা যায় আব্বাসীয় খলিফারা শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে উজিরের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতেন। উজিরের পরবর্তী উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। তার দায়িত্ব ছিল রাজ পরিবারের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং খলিফা ও তার পরিবারের সদস্যবৃন্দের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কেউ খলিফার সাক্ষাৎ প্রার্থী হলে হাজিব তাকে খলিফার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। তাই হাজিবকে রাজপরিবারের নিরাপত্তা অফিসার বলা হত।
রাজস্ববিভাগ : ভূমি, ট্যাক্স, জিজিয়া, আমদানি কর প্রভৃতি ছিল জাতীয় আয়ের মূল উৎস, রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের সাহেবুল খারাজ বলা হত। এর তত্ত্বাবধানে অসংখ্য কর্মচারী রাজস্ব আদায় করতেন। আব্বাসীয় শাসনতন্ত্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ছিল দেওয়ান-উল-খারাজ বা রাজস্ব বিভাগ।
দেওয়ান-উল-কাজা (বিচার বিভাগ) : আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের বিচার ব্যবস্থা কাজীর মাধ্যমে পরিচালনা করা হত। প্রধান বিচারপতির উপাধি ছিল কাজী-উল-কুযাত। এরপর প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে প্রধান কাজী থাকতেন। বিচারকার্য ইসলামি নিয়মানুযায়ী পরিচালিত হত। সামরিক বিভাগ : সামরিক প্রধান থাকতেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে খলিফা। আব্বাসীয়রা সকল শ্রেণি ও সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করতেন। এই নীতি অনুসরণের ফলে লোকেরা দলে দলে স্বেচ্ছায় সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করত। আব্বাসীয় শাসনাকালে সৈন্য সংখ্যা আগের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। আব্বাসীয় সৈন্যবাহিনী নিয়মিত ও অনিয়মিত এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল।
দেওয়ানুল বারিদ : দেওয়ানুল বারিদ বা ডাক বিভাগ আব্বাসীয় কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। বিশাল সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য উমাইয়াদের অনুকরণে ডাক বিভাগ স্থাপন করেন। এ বিভাগের প্রধানকে সাহেবুল বারিদ বলা হত। ডাক বাহনের জন্য উট ও অশ্ব ও খচ্চরের ব্যবহার হত। গোয়েন্দা দপ্তর এই বিভাগের অধীনে ছিল। মূলত ডাকবহনকারীরাই গোয়েন্দা বিভাগের কাজ করত।
শাসন বিভাগ : শাসন বিভাগের সুবিধার জন্য রাষ্ট্রকে কতগুলো প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল। প্রদেশের প্রধানকে আমীর বলা হত। আমীরের অধীনে মন্ত্রীসভা কাজ করত।
ব্যবসা-বাণিজ্য : এই যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম উন্নতি সাধিত হয়েছিল। বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি লাভ করেছিল। বাগদাদ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে সুনাম অর্জন করেছিল।
কৃষিকার্য : কৃষির উন্নয়নের জন্য খলিফারা মনোনিবেশ করতেন। তারা সেচ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে খাল খনন, জমিজরিপ সবকিছুই করতেন। সমগ্র দেশ সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা হয়ে উঠেছিল।
অন্যান্য উন্নয়ন : দেশের বিভিন্ন স্থানে হসপিটাল, বিশ্রামাগার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। একমাত্র বাগদাদ শহরে হাজার হাজার মসজিদ, সরাইখানা, গ্রন্থাগার নির্মিত হয়। বাগদাদের বাইতুল হিকমাদ ও নিজামিয়া মাদ্রাসা সেকালের প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল।
মানসিক উন্নতি : ইমাম গাজ্জালী, ইবনে সিনা, আল-ফারাবি, দার্শনিক আল কিন্দীর খ্যাতি দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। চিকিৎসাবিদ্যায় ইবনে সিনা, হুসাইন ইবনে ইসাহক, আল বীজি, আল হাসান, উমর খৈয়াম, আল-ফারারী, মুসা-বিন-সাকির প্রমুখ মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছিল এ যুগে। সর্বোপরি আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় প্রত্যেক বিভাগের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের ফলে আব্বাসীয় শাসন দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সুদীর্ঘ পাঁচশত কাল আব্বাসীয় শাসন টিকেছিল।
আরও পড়ুন
আব্বাসীয় খলিফা হিসাবে আল-আমীন-এর অবদান আলোচনা করো। 👉 Click Here
আব্বাসীয় শাসনের পতনের কারণগুলি লেখো। 👉 Click Here
খলিফা মানসুরকে আব্বাসী খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় কি? সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো। 👉 Click Here
উমাইয়া ও আব্বাসী শাসনামলের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো। 👉 Click Here
আব্বাসীয় যুগের স্থাপত্য শিল্পের ওপর টীকা লেখো। 👉 Click Here
আমিন ও মামুনের গৃহযুদ্ধের কারণ বর্ণনা করো। 👉 Click Here
সেলজুক কাদের বলা হত? 👉 Click Here
আব্বাসীদের সমাজ জীবন কেমন ছিল ? 👉 Click Here
টীকা লেখো : সিটি অব বাগদাদ। 👉 Click Here
খলিফা হারুণ অর রসিদ-এর সম্পর্কে আলোচনা করো। 👉 Click Here
খোলাফায়ে আব্বাসীয়র বৈশিষ্ট্য কি আলোচনা করো। 👉 Click Here
আব্বাসীয় বংশের সমস্ত MCQ প্রশ্ন ও উত্তর। 👉 Click Here
আব্বাসীয় বংশের সমস্ত SAQ প্রশ্ন ও উত্তর। 👉 Click Here
আব্বাসীয় বংশের সমস্ত সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর। 👉 Click Here