ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার বিষয়ে আলোচনা করো।
সূচনা:
ঊনবিংশ শতকে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় যে আমূল পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল তার মূলে ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার বলতে এখানে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকেই বোঝানো হয়ে থাকে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে ভারতবাসীর মধ্যে থাকা কুসংস্কারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে এবং যুক্তিবাদী ধ্যানধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে ভারতীয়রা কুসংস্কার মুক্ত হয় এবং তাদের মনে প্রগতিমূলক চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটে।
ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার:
ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের সূচনা হয়েছিল অষ্টাদশ শতকের অন্তিম ভাগ থেকে। তবে ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষা দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করে।
শ্রীরামপুর মিশনারিদের উদ্যোগে মার্শম্যান, উইলিয়াম কেরি প্রমুখ মিশনারি 1800 খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের উদ্যোগে বাংলা সহ 27টি ভারতীয় ভাষায় বাইবেল অনূদিত হয়। এই মিশন প্রতিষ্ঠিত 126টি স্কুলে দশ হাজার ভারতীয় ছাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ করে। তাঁদের উদ্যোগে 1818 খ্রিস্টাব্দে গড়ে ওঠে শ্রীরামপুর কলেজ।
অন্য মিশনারিদের উদ্যোগ:
অন্য মিশনারিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লন্ডন মিশনারি সোসাইটি এবং চার্চ মিশনারি সোসাইটি। স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফ জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলেন। মিশনারিদের উদ্যোগে শিবপুরে বিশপ কলেজ, মাদ্রাজে খ্রিস্টান কলেজ, বোম্বাইয়ে উইলসন কলেজ গড়ে ওঠে।
মেকলে মিনিটস:
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিষ্কের নির্দেশে টমাস ব্যারিংটন মেকলে 1835 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের বিখ্যাত 'মেকলে মিনিটস' ঘোষণা করেন। এর ফলে ইংরেজি শিক্ষাকে সরকারি শিক্ষানীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
উডের নির্দেশনামা:
1854 খ্রিস্টাব্দে বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড তাঁর বিখ্যাত 'উডের ডেসপ্যাচ' ঘোষণা করেন। এই নির্দেশনামা অনুসারে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য কলকাতা, বম্বে ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয় যে কারণে উডের নির্দেশনামাকে পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের 'ম্যাগনা কার্টা' বলা হয়।
বিদেশিদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ:
ভারতে ব্রিটিশ শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলে সরকারি অফিস, আদালত, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি জানা কর্মচারী দরকার ছিল। সরকারি চাকরি পাবার টানে মধ্যবিত্ত বাঙালি ইংরেজি শিখতে আগ্রহী হয়। এদের প্রয়োজনে কিছু বিদেশি ব্যক্তি ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। যেমন-শোরবোর্ন, মার্টিন, ডেভিড ড্রামন্ড প্রমুখ প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়।
জনশিক্ষা কমিটির স্থাপনা:
ব্রিটিশ সরকার সম্পূর্ণ সরকারি উদ্যোগে ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের জন্য 1823 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করে 'জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন' বা 'জনশিক্ষা কমিটি'। পরবর্তীকালে কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ গড়ে ওঠে জনশিক্ষা কমিটির উদ্যোগে।
মূল্যায়ন :
উপরিউক্ত আলোচনায় স্পষ্ট, ভারতবর্ষে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের জন্য ব্রিটিশ সরকার এবং অনেক বিদেশি ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলে একাধিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এক্ষেত্রে বলা যায়, ব্রিটিশ সরকার প্রথম পর্যায়ে নিজেদের প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাতে ভারতীয় সমাজ সংস্কার আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদে জোয়ার আসে।