ভারতীয় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের কী ফলাফল দেখা গিয়েছিল?

 সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকার এদেশে কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল?

সূচনা:

 ঊনবিংশ শতক ছিল ভারতবর্ষের সংস্কার আন্দোলনের স্বর্ণযুগ। এইসময় ভারতীয় মনীষীদের সাথে কিছু ক্ষেত্রে বিদেশিরা সংস্কার আন্দোলনে ব্রতী হয়েছিল। এইসময় ভারতবর্ষে সামাজিক, ধর্মীয় সংস্কারে যেমন অনেক ছোটো-বড়ো সংগঠন এগিয়ে এসেছিল ঠিক তেমনি এগিয়ে এসেছিলেন অনেক মনীষী ব্যক্তি। ঐতিহ্যময় পুরাতন ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি নিষ্ঠাবান থেকেও আধুনিক জগৎ ও আধুনিক বিজ্ঞানকে স্বীকার করে নিতে ভারতবাসী দ্বিধা করেনি।

সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ফলাফল ঊনবিংশ শতকে ভারতে সংস্কার আন্দোলনের ফলাফলগুলি ছিল এইরকম-

 যুক্তিবাদের বিকাশ:

 ভারতবর্ষে সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম ফলশ্রুতি ছিল যুক্তিবাদের বিকাশ। অর্থাৎ ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করতে সংস্কারকগণ যখন সাধারণ মানুষকে যুক্তিসচেতন করতে শুরু করেন তখন সমাজে যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটে।

 সামাজিক শ্রেণিবিভাজন নিবারণ: 

তৎকালীন ভারতীয় সমাজ ছিল বহু শ্রেণিবিভক্ত। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের এই ব্যাধি দূর হয়েছিল সংস্কার আন্দোলনের ফলে।

আধুনিকতার উদ্ভব: 

সংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতবাসীর মনে আধুনিকতা ও জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটে। অবশ্য জাতপাত, বর্ণ ও ধর্মের বাছবিচার সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছিল এমন বলা যায় না।

 জাতীয় ঐক্যের সূচনা:

 সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম ফলাফল ছিল জাতীয় ঐক্যের সূচনা যা ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়।

 সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার অবসান: 

এই আন্দোলনের ফলশ্রুতি হলো বিশ্বের সঙ্গে ভারতবাসীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার অবসান। সেই সময় থেকে আধুনিক বিশ্বের চিন্তাধারা ও আদর্শের সঙ্গে ভারতবাসীর পরিচিতির পালা শুরু হয়।

 পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের বিকাশ: 

সামাজিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল।

সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগ:

সতীদাহপ্রথা:

 সতীদাহপ্রথা নিবারণ আইন সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার 1829 খ্রিস্টাব্দে আইন পাশ করে 'সতীদাহপ্রথা' আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করে।

মেকলে মিনিটস:

মেকলে মিনিটস-এর প্রকাশ ভারতীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে 1835 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার 'মেকলে মিনিটস' প্রকাশ করে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার যেমন ঘটিয়েছিল ঠিক তেমনি ইংরেজি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক বলে ঘোষণা করে।

বিধবাবিবাহ:

বিধবাবিবাহ প্রচলন সমাজ সংস্কার আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার 1856 খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ আইনসম্মত বলে ঘোষণা করে।

 দাসত্বপ্রথার অবসান: 

সংস্কার আন্দোলনের অপর একটি ফলশ্রুতি ছিল দাসত্বপ্রথার অবসান। 1843 খ্রিস্টাব্দে বড়োলাট অকল্যান্ড আইন জারি করে ভারতে দাসত্বপ্রথার অবসান ঘটান।

নরবলিপ্রথা বন্ধ:

 পূর্বে ভারতীয় সমাজে জমির উর্বরতাশক্তি বৃদ্ধির জন্য নরবলিপ্রথার প্রচলন ছিল। এই বর্বর প্রথাটি বন্ধ করার জন্য লর্ড হার্ডিঞ্জ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। অবশেষে 1847 ও 1854 খ্রিস্টাব্দে সরকার আইন করে এই ঘৃণ্য প্রথা বন্ধ করে।

তিন আইন পাশ:

 কেশবচন্দ্র সেনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার 1872 খ্রিস্টাব্দে 'তিন আইন' পাশ করে। এই আইন পাশের দ্বারা অসবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ হয়।

মূল্যায়ন : 

উপরিউক্ত আলোচনার স্পষ্ট, সমকালীন ভারতের সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে এদেশের সংস্কারকদের প্রচেষ্টা ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই সফল হতো না।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
×