ডিরোজিওর নেতৃত্বাধীন নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বিবরণ দাও। এই আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়েছিল?

 সূচনা:

 ঊনবিংশ শতকে বাংলায় সংস্কার আন্দোলন তথা পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে যেসকল ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ডিরোজিওর অনুপ্রেরণায় তাঁর অনুগামী যুবকরা যুক্তিবাদী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। ডিরোজিওর অনুগামীরা যে প্রগতিশীলতার সাথে বাংলায় সংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা বাংলায় নবজাগরণের ক্ষেত্র প্রস্তুতে সহায়ক হয়েছিল তা বলা যায়।

নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী:

 সমকালীন বাংলায় যুক্তিবাদের কেন্দ্রবিন্দু হিন্দু কলেজের ছাত্ররা হিউম, লক, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ যুক্তিবাদী দার্শনিকের দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে ডিরোজিওর নেতৃত্বে যে গোষ্ঠী গড়ে তোলেন তা 'নব্যবঙ্গ' বা 'Young Bengal গোষ্ঠী নামে পরিচিত।

ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্য ডিরোজিওর অনুগামী ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন-রামতনু লাহিড়ি, দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ।

ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর আদর্শ: 

সমকালীন বাংলায় দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত কুসংস্কারগুলির বিরুদ্ধে ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তাঁরা চেয়েছিলেন সমাজ থেকে যাবতীয় ভণ্ডামি বা লোকদেখানো নিয়মকানুনগুলির অবসান ঘটাতে। ডিরোজিও তাঁর অনুগামীদের বলতেন, "সত্যের জন্য বাঁচো, অসত্য থেকে যুক্ত হও।”

সংস্কারমুখী আন্দোলন:

 ডিরোজিও এবং তাঁর নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্যরা তৎকালীন সময়ের হিন্দুসমাজের কুসংস্কার, রক্ষণশীলতা ও প্রচলিত কুপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তৎকালীন হিন্দুসমাজের বহুবিবাহ প্রথার অবসান, নারীশিক্ষার প্রসার, জুরির বিচার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও নব্যবঙ্গ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।

অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা: 

ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল চিন্তার সঙ্গে পরিচয় ঘটান। এইসময় তিনি 1828 খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মানিকতলায় প্রতিষ্ঠা করেন 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন'। এই প্রতিষ্ঠানটি ছিল ভারতবর্ষের প্রথম ছাত্র সংগঠন।

নব্যবঙ্গ আন্দোলনের মুখপত্র:

 ডিরোজিও তাঁর আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেবার জন্য কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। যেমন 'এথেনিয়াম', 'পার্থেনন' প্রভৃতি।

 নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা/ ব্যর্থতার কারণ:

 শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ:

 নব্যবঙ্গ আন্দোলনের কর্মসূচি খুব অল্প জায়গায় অর্থাৎ কেবলমাত্র কলকাতা শহরকেন্দ্রিক ছিল। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আন্দোলন পৌঁছাতে পারেনি যা ছিল এই আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।

প্রগতিশীল চিন্তাধারায় ছেদ: 

নব্যবঙ্গীয় নেতারা ধারাবাহিকভাবে প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও কার্যকলাপ অনুসরণ করেননি। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মনে অরুণ্যের উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে পড়ে।

কৃষকদের প্রতি উদাসীন:

 নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সাথে যুক্ত প্রায় প্রত্যেকে ছিলেন উচ্চবিত্ত জমিদার পরিবার থেকে আগত। তাঁরা কৃষকদের প্রতি ছিলেন উদাসীন যা এই আন্দোলন ব্যর্থ হবার জন্য অনেকাংশে দায়ী।

মুসলিমদের প্রতি ঔদাসীন্য:

 নব্যবঙ্গ আন্দোলনে ভারতীয় মুসলিম সমাজের জন্য সংস্কার দাবি করা হয়নি। তেমনি মুসলিমগণও এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি।

 যোগসূত্রের অভাব: 

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষদের কোনো যোগসূত্র ছিল না। তারা বক্তৃতা ও পুস্তিকার মাধ্যমে আন্দোলন সচল রাখত।

সমাজচ্যুত গোষ্ঠী: 

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী ছিল তৎকালীন সময়ে সমাজচ্যুত গোষ্ঠী।

মূল্যায়ন: 

ভারতের নবজাগরণের ইতিহাসে ইয়ং বেঙ্গলরা ছিল বিশিষ্ট পুরুষ। শিবনাথ শাস্ত্রী 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' গ্রন্থে বলেছেন- "ডিরোজিও তিন বছরকাল মাত্র হিন্দু কলেজে ছিলেন, কিন্তু এই তিন বছরের মধ্যে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে এমন কিছু রোপণ করেছিলেন, যা তাদের অন্তরে আমরণ বিদ্যমান ছিল।" ডিরোজিও মনেপ্রাণে ছিলেন স্বদেশপ্রেমী। 'To my native land' বা 'আমরা স্বদেশের প্রতি' নামক কবিতায় ডিরোজিও মাতৃভূমিকে বন্দনা করেছেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
×