উনবিংশ শতাব্দীতে উদ্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য লেখো।
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে উদ্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
সূচনা:
ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনকালে বিশেষ করে উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তন ছিল সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব। 1757-1833 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতীয় শাসন ও বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন এবং গ্রামীণ ঐতিহ্যের অবক্ষয়ের জন্য ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় 'মধ্যবিত্ত' নামক এক নতুন শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এইসময় নতুন সামাজিক শ্রেণি হলেও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈশিষ্ট্য:
কর্মজীবন:
তৎকালীন ভারতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়েছিল তারা নির্দিষ্ট কিছু কাজের সাথে যুক্ত ছিল। যেমন-দেওয়ান, বেনিয়ান, গোমস্তা, মুৎসুদ্দি ইত্যাদি। তারা মূলত ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ছোটোখাটো চাকুরি করে তাদের কর্মজীবন অতিবাহিত করত।
পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুরাগী:
সমকালীন সময়ে মধ্যবিত্তরা প্রাচ্য বা দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তারা ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার হাত ধরে পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও স্বাধীন চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হতো।
মানবিক বোধ প্রতিষ্ঠা:
মধ্যবিত্ত শ্রেণির অপর এক বৈশিষ্ট্য হলো মানবিক বোধের প্রতিষ্ঠা। মানবিক অধিকার সম্পর্কে নতুন ধারণা এবং এই ধারণার প্রসার একে একে আদর্শবাদের পর্যায়ে উন্নীত হয়।
আর্থিক সংগতি:
মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিল, কিছু সংখ্যক ছিল ব্যাপক ভূসম্পত্তির মালিক। আবার অধিকাংশই ছিল মাঝারি আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন।
কর্মহীনতা:
মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রধানত ব্রিটিশদের অধীনে চাকুরি করে জীবিকা নির্বাহ করত কিন্তু এই সম্প্রদায় পরবর্তীকালে ক্রমবর্ধমান কর্মহীনতার মুখোমুখী হয়।
মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা:
মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মূল্যবোধের প্রতি আগ্রহ। শুধমাত্র জীবিকার ক্ষেত্রেই নয়, জীবনবোধের ক্ষেত্রে এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের প্রতি এই শ্রেণি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল যার ফলশ্রুতি ছিল মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা।
ধর্ম ও জাতি সম্পর্ক:
মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৎকালীন সময়ে রক্ষণশীল সনাতন হিন্দু ধর্মের থেকে ব্যয়বহুল খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছিল। এইসময় ধর্মের বন্ধন শিথিল হয়ে উদার ও সহনশীল হয়ে ওঠে যা বর্ণ ও জাতিবৈষম্যকে কঠোর করে তোলে।
নগর ও শহরকেন্দ্রিকতা:
ঔপনিবেশিক শাসনকালে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান,অফিস-আদালত গড়ে উঠেছিল শহরে যা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে শহরের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। বহু ক্ষেত্রে তারা গ্রামের সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।
সাম্প্রদায়িক সচেতনতা:
মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের সাম্প্রদায়িক স্বরূপ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিল। সেইসময় উচ্চবর্ণজাত, ধনী, প্রভাবশালী প্রভৃতি বিষয় কোনো গোষ্ঠীর প্রধান হওয়ার জন্য যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হতো।
সংখ্যায় স্বল্পতা:
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে সারা ভারতের শিক্ষিত ভারতীয় মধ্যবিত্তের সংখ্যা আজকের দিনের দিল্লির মতো ক্ষুদ্র অঞ্চলের শিক্ষিত নাগরিকের চেয়েও কম ছিল।