কোম্পানির আমলে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় সম্পর্কে লেখো।
কোম্পানির আমলে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয় সম্পর্কে লেখো। অথবা, ঔপনিবেশিক শাসনকালে ভারতে শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসের কারণ ও ফলাফল উল্লেখ করো।
সূচনা: অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ পর্যন্ত ভারতবর্ষ ছিল বাণিজ্য ও শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করার ক্ষেত্রে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। এইসময় বাংলার রেশম, ঢাকার মসলিন এবং রেশমজাত পোশাক ছিল জগৎবিখ্যাত। কিন্তু ভারতবর্ষে কোম্পানির শাসনকালে ইংল্যান্ড থেকে আগত শিল্পবিপ্লবজাত দ্রব্যসামগ্রী বাংলা তথা ভারতের দেশীয় শিল্পে এক অন্ধকার যুগের সূচনা করে।
দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের কারণ:
ঔপনিবেশিক শাসনকালে দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের কারণ হিসেবে বলা যায়-
দস্তকের অপব্যবহার:
1717 খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ফারুখশিয়ার কোম্পানিকে বিনা শুল্কে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায় বাণিজ্য করার যে ফরমান প্রদান করেন তা-ই হলো দস্তক। এই দস্তকের অপব্যবহার ছিল দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
দাদনপ্রথার কুফল:
দাদনপ্রথার মাধ্যমে কোম্পানি তাঁতি, নীলচাষিদের অগ্রিম অর্থ বা দাদন দিত। কিন্তু দাদনগ্রহীতা ভারতীয়রা তখন কোম্পানির অনুগত শ্রেণিতে পরিণত হতো যা দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের অপর একটি কারণ।
কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য:
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে বাণিজ্য শুরু করলে দস্তকের অপব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে দেশীয় বণিকদের ক্ষতিপূরণের মতো সাধ্য ছিল না।
তুলোর একচেটিয়া কারবার:
ভারতবর্ষে উৎপাদিত তুলোর ওপর কোম্পানি একচেটিয়া অধিকার আরোপ করেছিল। ফলে ভারতীয় বণিকদের মধ্যে দেখা দেয় তুলোর সংকট যা দেশীয় বস্ত্রশিল্পের ব্যাপক ক্ষতি করে।
বিলেতি সস্তা পণ্য:
ইংল্যান্ড থেকে যেসব শিল্পপণ্য বিক্রির জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছিল সেগুলির দাম ছিল ভারতীয় পণ্যের থেকে কম। ফলে এদেশের গরিব মানুষ সস্তা পণ্য কিনতেই উৎসাহী হয়।
উন্নত শিল্পসামগ্রী:
ইংল্যান্ডের উন্নত যন্ত্রে উৎপন্ন পণ্যসামগ্রীর মান ছিল ভারতের কুটির শিল্পজাত সামগ্রীর থেকে উন্নত। তাই এদেশের ধনী ও মধ্যবিত্তরা বিলাতি পণ্যেই বেশি ঝুঁকত।
অবাধ বাণিজ্য:
1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন অনুসারে কোম্পানি একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার পায় যা ভারতবর্ষে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের অপর একটি কারণ।
ফলাফল / প্রভাব:
কাঁচামাল রপ্তানি:
ভারতবর্ষে দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের সূচনা হলে কাঁচা তুলো, রেশম, নীল, চা ইত্যাদি নিয়মিত ভারতবর্ষ থেকে ইংল্যান্ডের কারখানায় চলে যেতে থাকে। ফলে ভারত শিল্পনির্ভর দেশের পরিবর্তে কৃষিপ্রধান দেশে পরিণত হয়।
বেকারত্ব:
শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস হওয়ায় দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে যায়। শিল্পী, কারিগররা উপায় না পেয়ে বিশেষ করে কৃষিকার্যে মন দেয়। ফলে কৃষিক্ষেত্রে চাপ বাড়তে থাকে। এভাবে দেশে কৃষক ও ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বেড়ে যায়।
আমদানিকারক দেশ:
দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ে ভারতবর্ষ একটি শিল্পসমৃদ্ধ রপ্তানিকারক দেশ থেকে আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়।
অর্থনৈতিক দুর্বলতা:
দেশীয় শিল্পের ধ্বংসের ফলে চিরাচরিত অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। এতে ভারতবর্ষ একটি দুর্বল দেশে পরিণত হয়।