পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল তুলনামূলক আলোচনা করো।
সূচনা: বাংলা তথা ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল 1757 খ্রিস্টাব্দের পলাশি যুদ্ধ। 1757 খ্রিস্টাব্দের 23 জুন বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘটিত হয় পলাশির যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কোম্পানি জয়লাভ করলে বাংলায় স্বাধীন নবাবির অবসান ঘটে এবং কোম্পানির অধীনে নবাবি শাসনের অন্তরালে মূলত কোম্পানির শাসনের সূচনা হয়। ঐতিহাসিক ম্যালেসন বলেছেন, "পলাশির যুদ্ধের মতো আর কোনো যুদ্ধের ফলাফল এত ব্যাপক ও স্থায়ী হয়নি।"
ফলাফল:
বাংলার পরাধীনতা পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের। ফলে বাংলা পরাধীন হয়ে পড়ে। ইংরেজরা মিরজাফরকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজেরা সিংহাসনের পশ্চাৎ শক্তিতে পরিণত হয়।
কোম্পানির সার্বভৌমত্ব:
একচেটিয়া বাণিজ্য:
পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে কোম্পানি দস্তক বা বিনা শুল্কে বাণিজ্যিক অধিকার প্রয়োগ করে বাংলার বাণিজ্যে একচেটিয়া প্রাধান্য স্থাপন করে। ধ্বংস হয় দেশীয় ব্যাবসাবাণিজ্য।
রাজনীতিতে প্রাধান্য:
এই যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রকৃত নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয় কোম্পানি। বাংলার নবাব কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হন।
প্রশাসনিক শূন্যতা:
পলাশির যুদ্ধে বাংলার নবাবের পরাজয়ে বাংলায় ভয়াবহ রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হয়। বাংলায় দেখা দেয় প্রশাসনিক শূন্যতা। কোম্পানি ইচ্ছামতো ব্যক্তিকে নবাব পদে বসায়।
পলাশির যুদ্ধের প্রায় সাত বছরের মাথায় বাংলার বুকে নেমে আসে আরও ভয়াবহ পরিণতি। এইসময় অর্থাৎ 1764 খ্রিস্টাব্দে কেবলমাত্র বাংলা নয়-একসাথে বাংলা, অযোধ্যা ও দিল্লির মিলিত বাহিনীকে কোম্পানি চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে, যা ছিল সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ঘটনা। জেমস স্টিফেন বলেছেন- "ভারতে ব্রিটিশ শক্তির উৎস হিসেবে বক্সারকে গণ্য করা হয়।"
ফলাফল:
দেওয়ানি লাভ:
বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে কোম্পানি। এতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভের পাশাপাশি কোম্পানির আর্থিক লাভ হয়েছিল।
আর্থিক লুণ্ঠন:
বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে বাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে কোম্পানির একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। এই সুযোগে শুরু হয় আর্থিক লুণ্ঠন। মিরকাশিমের কাছ থেকে 15 লক্ষ টাকা উপঢৌকন আদায় করা হয়।
ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ:
বক্সারের যুদ্ধ ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসে ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ। এই কারণে ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র বলেছেন-"এটি ছিল ভারতের ইতিহাসে সর্বাধিক নিষ্পত্তিমূলক নির্ণায়ক।"
উত্তর ভারতে আধিপত্য স্থাপন:
বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর কোম্পানি উত্তর ভারতে নজর দেয়। অযোধ্যার নবাব কোম্পানি অনুগত হন। উত্তর ভারতে কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা:
বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলায় ব্রিটিশ শক্তির আধিপত্যের পথ থেকে সব বাধা দূর হলো। বাংলা সহ ভারতে কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সহজ হয়ে ওঠে।
উপসংহার:
উপরিউক্ত আলোচনায় স্পষ্ট, পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধ ছিল কোম্পানির ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনের মূল প্রবেশদ্বার। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে-"পলাশির যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতে মধ্যযুগের অবসান হয় এবং আধুনিক যুগের সূচনা হয়।” অবশ্য বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পরই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয়। এ প্রসঙ্গে র্যামসে মুর বলেছেন, "বক্সার বাংলার ওপর কোম্পানির শাসন-শৃঙ্খল চূড়ান্তভাবে স্থাপন করেছিল"।