চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর সংক্ষিপ্ত টীকা লেখো। অথবা, কে, কবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল লেখো। অথবা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের সুফল ও কুফল লেখো।
সূচনা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন জারি করার পর ভারতবর্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক মুনাফা লাভের আশায় 1773 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে কোম্পানি নতুন নতুন ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত প্রয়োগ করে। এই ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্তের মধ্যে অন্যতম ছিল 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত'।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়োগ:
1793 খ্রিস্টাব্দের 22 মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ওপর চিরস্থায়ী ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত প্রয়োগ করেন।
ফলাফল:
চিরস্থায়ী ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে কোম্পানি, জমিদার, কৃষক এই তিনটি শ্রেণিরই কিছু-না-কিছু লাভ ও ক্ষতি হয়েছিল।
সুফল: মার্শম্যানের মতে-চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল একটি দৃঢ় সাহসিকতাপূর্ণ ও বিচক্ষণ পদক্ষেপ। এর সুফলগুলি ছিল নিম্নরূপ-
বার্ষিক আয় নিশ্চিতকরণ: চিরস্থায়ী ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত অনুসারে কোম্পানির বার্ষিক আয় নিশ্চিত হয়।
বার্ষিক বাজেট প্রস্তুত: চিরস্থায়ী ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত অনুসারে কোম্পানির বার্ষিক আয় সুনির্দিষ্ট হবার ফলে কোম্পানি বার্ষিক বাজেট প্রস্তুতে তা সহায়ক হয়েছিল।
জমির উন্নতির প্রচেষ্টা: এই বন্দোবস্তে জমিদারগণ নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব প্রদান করলে জমিদারি হারানোর ভয় দূর হয়। এর ফলে তারা জমিগুলির ও প্রজাদের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হয়।
কৃষির উন্নতি: এই বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে কৃষির উন্নতি ঘটে। ফলে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
গ্রামাঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা: এই বন্দোবস্ত অনুসারে গ্রামে জমিদারদের নেতৃত্বে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। তারা গ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতে উদ্যত হয়েছিল।
কুফল: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলগুলির তুলনায় কুফলগুলি ছিল অত্যন্ত প্রকট। ঐতিহাসিক হোম্স চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে বলেছেন- "একটি দুঃখজনক ভুল।" আবার অন্যদিকে এডওয়ার্ড থর্নটন বলেন- "চরম অজ্ঞতা থেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সৃষ্টি।" এই ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্তের কুফল ছিল এইরকম-
গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাঙন: চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে গ্রাম্য উৎপাদন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়। এইভাবে গ্রাম্য অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
রাজস্ব বৃদ্ধি না হওয়া: এই ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত অনুসারে পরবর্তীকালে জমির মূল্য বা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও কোম্পানির রাজস্ব বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
কৃষক জমির স্বত্ব হারায়: এই ব্যবস্থায় কৃষকদের জমির ওপর কোনো স্বত্ব থাকত না।
মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব: অনেক জমিদার রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থ হয়ে জমি ইজারা দেয়। ফলে ইজারাদার, দর ইজারাদার, পাওনাদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব হয়।
চড়া হারে রাজস্ব আদায়: চিরস্থায়ী ভূমিবন্দোবস্তে রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করার পূর্বে জমি প্রকৃতপক্ষে জরিপ করা হয়নি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে সেইসময়ের পক্ষে খাজনা অধিক হারে স্থির হয়েছিল।
কুটির শিল্পের অবনতি: চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষির উন্নতিতে অর্থ লগ্নি করলে কুটির শিল্পের অবনতি হতে থাকে।