বাণিজ্যিক মূলধন কীভাবে শিল্পপুঁজি মূলধনে রূপান্তরিত হয়? এই মতবাদের প্রধান বক্তব্য কী?

 সূচনা: সমগ্র বিশ্বজুড়ে যখন ভৌগোলিক আবিষ্কার শুরু হয় তখন থেকেই বিশ্বের বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে মার্কেন্টাইল নামক অর্থনৈতিক মতবাদ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। এইসময় অ্যাডাম স্মিথের নেতৃত্বে নতুন ধারার অর্থনৈতিক চিন্তা ইউরোপে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই অর্থনৈতিক ব্যাখ্যায় শিল্প ও বাণিজ্যের নতুন নতুন ক্ষেত্রে মূলধন বিনিয়োগ করলে তা পুঁজিবাদের মূলধনে রূপান্তরিত হয় এইভাবে-

বাণিজ্যবাদী ধনতন্ত্র:

 ধনতন্ত্রের প্রথম পর্যায়ে বাণিজ্যবাদী ধনতন্ত্রের উদ্ভব হয়। রাষ্ট্র কর্তৃক শিল্পসংরক্ষণ নীতি অবলম্বন, ঔপনিবেশিক নীতির প্রসারের ফলে বাণিজ্যকেন্দ্রিক ধনতন্ত্র প্রসার লাভ করে।

বাণিজ্যিক মূলধন কীভাবে শিল্পপুঁজি মূলধনে রূপান্তরিত হয়? এই মতবাদের প্রধান বক্তব্য কী?

পুঁজিপতিদের উদ্ভব: 

ইউরোপে শিল্পবিপ্লব পুঁজিবাদের উত্থান ঘটায়। এইসময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিল্পজাত দ্রব্য অন্য দেশের শিল্পের সাথে প্রতিযোগিতায় যাতে পিছু না হটে সেই জন্য বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশীয় সরকার 'শুল্ক সংরক্ষণ নীতি' চালু করে। এর দ্বারা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে থাকলে পুঁজিপতি শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। আর এভাবেই ইউরোপে পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্রের উদ্ভব হয়।

পুঁজি বিনিয়োগ: 

পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় পুঁজিপতি মালিকরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করে। এই মুনাফা অর্জনের কাজটি এককালীন নয়, এটি একটি ধারাবাহিক পুনরুৎপাদনমূলক প্রক্রিয়া। তাই ইউরোপীয় পুঁজিপতি শ্রেণি নিজেদের বিপুল পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ করে বিভিন্ন উপনিবেশে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। তারা বাণিজ্যিক কার্যাবলি পরিচালনা করতে থাকে আর এভাবেই বাণিজ্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা মূলধন শিল্প ও পুঁজিবাদের মূলধনে রূপান্তরিত হয়।

কাঁচামাল সংগ্রহ: 

ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে পুঁজিপতিরা যে বিপুল মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে তা তারা শিল্প উৎপাদনের কাজে বিনিয়োগ করে। এই শিল্প উৎপাদনের কাজ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল কাঁচামালের জোগান।

 পণ্য বিক্রয়: 

শিল্পবিপ্লবের দরুন অত্যন্ত কম ব্যয়ে উৎপাদিত শিল্পপণ্য বহুগুণ বেশি দামে আফ্রিকা, এশিয়া এবং আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করা শুরু হয়। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এর দ্বারা একদিকে যেমন উপনিবেশবাদের উদ্ভব ঘটে অন্যদিকে তেমনি বাণিজ্যিক মূলধন পুঁজিবাদী মূলধনে পরিণত হয়।

উপসংহার:

বাণিজ্যিক মূলধন পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হওয়ায় উপনিবেশগুলির দেশীয় বণিকরা তাদের সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে যা শিল্পের ক্ষেত্রে দেশীয় কুটির শিল্পকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। উপরিউক্ত মতবাদের প্রেক্ষিতে প্রধান বক্তব্যে বলা যায়-বাণিজ্যিক মূলধন পুঁজিবাদের প্রভাবে সমাজের আর্থিক ভিত্তিতে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণির উদ্ভব ঘটায়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বাণিজ্যিক মূলধন ছোটো-বড়ো বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগ করা হলে তার দ্বারা বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী উৎপাদিত হয়। আর সেই শিল্পসামগ্রী বিশ্ববাজারের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বাণিজ্যিক কারণে তখন সেই শিল্পসামগ্রী বিক্রয় করার ফলে যে মুনাফা অর্জিত হয় তা চলে যায় মালিক শ্রেণির হাতে। ফলে একথা বলাই যায় যে বাণিজ্যিক মূলধনই প্রথমে শিল্পের মূলধনে এবং সবশেষে পুঁজিবাদের মূলধনে পরিণত হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
×