ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো।অথবা, ভারতে রেলপথ বিস্তারের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

 ভারতে রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য ও প্রভাব আলোচনা করো।অথবা, ভারতে রেলপথ বিস্তারের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো। অথবা, ভারতে কে, কবে রেলপথ স্থাপন করেন? রেলপথ স্থাপনের বিভিন্ন উদ্দেশ্য কী ছিল?

ভারতে রেলপথের স্থাপনা:

 ঔপনিবেশিক শাসনকালে 1832 খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে প্রথম রেলপথ স্থাপনের প্রস্তাব ওঠে। এর অন্তিম পরিণতিতে অর্থাৎ 1853 খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয়। প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে রেলপথ নির্মাণ সম্পন্ন হলেও রেল চলাচল খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যায়।

 রেলপথ স্থাপনের উদ্দেশ্য:

 নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্যপূরণের লক্ষ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে রেলপথ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই উদ্দেশ্যগুলি ছিল এইরকম-

কাঁচামাল রপ্তানি:

 ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটলে এইসময় শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয়। কাঁচামাল ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দ্রুত সংগ্রহ করে তা সরবরাহ করার প্রয়োজন ছিল। আর এই কাজের জন্য প্রযোজন ছিল উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, যে কারণে রেলপথ সম্প্রসারণের প্রয়োজন ছিল। ড: সব্যসাচী ভট্টাচার্য বলেছেন- "এইসব লাভের লোভই ছিল আসল কথা; এদেশের অর্থনীতির আধুনিকীকরণ মোটেই নয়।"

 ইংল্যান্ডে প্রস্তুত পণ্য দ্রুত সরবরাহ: 

ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপাদিত বিপুল পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য প্রয়োজন ছিল ভারতের মতো বৃহত্তর বাজার। ভারতের অভ্যন্তরে দূর দূরান্তে এই পণ্যসামগ্রী দ্রুত পৌঁছে দেবার জন্য প্রয়োজন ছিল উন্নত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার।

 পুঁজি বিনিয়োগ:

 শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটিশ শিল্পপতিরা বিপুল পরিমাণ পুঁজির মালিক হয়ে ওঠে। তারা সেইসময়ে ভারতে এই লাভজনক রেলপথ নির্মাণে মূলধন বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। কারণ এই বিনিয়োগ তাদের কাছে ছিল প্রচুর মুনাফা লাভের মাধ্যম।

 সামরিক প্রয়োজন:

 সামরিক প্রয়োজনেও ব্রিটিশরা রেলপথ বিস্তার করেছিল বলে মনে করা হয়। কোম্পানির শাসনকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত সৈন্যবাহিনী পাঠানোর প্রয়োজনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে রেলপথ বিস্তারে আগ্রহী হয়েছিল।

রাজনৈতিক প্রয়োজন: 

সুবিশাল ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যখন কোম্পানির দখলে চলে আসে সেইসময় ভারতবর্ষে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক তদারকির জন্য প্রয়োজন ছিল উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার। এই কারণে কোম্পানি ভারতবর্ষে রেলপথ স্থাপন করেছিল বলে মনে করা হয়।

 অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য: 

শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত দ্রব্য দ্রুত ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে দেবার অন্যতম মাধ্যম ছিল রেলপথ। তাই আর্থিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে রেলপথ বিস্তার করেছিল।

লর্ড ডালহৌসির উদ্দেশ্য: 

ভারতের দূরবর্তী অঞ্চলে দ্রুত সেনাবাহিনী পাঠানো, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে রেলপথ নির্মাণের প্রয়োজন আছে বলে ডালহৌসি মনে করতেন।

প্রভাব/ফলাফল:

 ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে রেলপথ নির্মাণের যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ করা যায় তা ছিল নিম্নরূপ-

 অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বৃদ্ধি: 

রেলপথের মাধ্যমে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারগুলির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল এবং এক স্থানের পণ্যসামগ্রী অন্যান্য অঞ্চলে সহজেই সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছিল।

 জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা: 

রেলপথের বিস্তার ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় রীতিনীতি, ভাষা ও গোষ্ঠীগত বিভেদের প্রাচীর ভেঙে দিয়ে যোগাযোগ ও মতামতের আদান-প্রদান দ্বারা জাতীয় ঐক্য ও জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি করে।

 প্রশাসনিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা: 

ভারতবর্ষে রেলপথ বিস্তারের ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য গড়ে ওঠে ও এদেশে ব্রিটিশ শাসনের ভিত আরও মজবুত করে।

উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার প্রচলন:

 ভারতে রেলপথ স্থাপনের ফলে এক নতুন ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

উপসংহার:

 ওপরের আলোচনায় স্পষ্ট, রেলপথ নির্মাণে কোম্পানির অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বলা যায়, ভারতে ইংল্যান্ডের শিল্পদ্রব্যের বাজার সম্প্রসারণ ও ব্রিটিশ পুঁজিপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
×