ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
সূচনা: যেকোনো দেশ বা সরকারের অর্থনীতির মানদণ্ড সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে সেই দেশের ভূমিরাজস্ব নীতির ওপর। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিরাজস্ব নীতি প্রয়োগ করেছিল। কোম্পানির এই অঞ্চল বা প্রদেশভিত্তিক ভূমিরাজস্ব নীতি প্রবর্তনের মূল কারণ ছিল অতিরিক্ত আর্থিক মুনাফা অর্জন।
কোম্পানির রাজস্বনীতির প্রাথমিক পদক্ষেপ:
ওয়ারেন হেস্টিংস-এর পদক্ষেপ:
1772 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার অবসান এবং নবাবের কর্মচারী কর্তৃক রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি বাতিল করে কালেক্টর নামে নতুন কর্মচারী নিয়োগ করেন। 1772 খ্রিস্টাব্দেই তিনি জমি ইজারাদারদের নিলামে দেবার জন্য 'ভ্রাম্যমাণ কমিটি' গঠন করেন।
পাঁচসালা ভূমিবন্দোবস্ত:
ভ্রাম্যমাণ কমিটির সুপারিশ অনুসারে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের আশায় কোম্পানি পাঁচসালা ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত নামে এক নতুন রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করে। এই পাঁচসালা বন্দোবস্ত বা ইজারাদারি বন্দোবস্ত অনুসারে কোম্পানি। আদায়কৃত রাজস্বের তথ্য সংগ্রহের জন্য গঠন করে 'আমিনি কমিশন'।
একসালা ভূমিবন্দোবস্ত:
ওয়ারেন হেস্টিংস পাঁচসালা বন্দোবস্তের বিভিন্ন ত্রুটি দূর করে আমিনি কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে এক বছরের জন্য প্রচলন করেন একসালা ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত।
দশসালা ভূমিবন্দোবস্ত:
লর্ড কর্নওয়ালিশ কৃষিব্যবস্থার উন্নতি, প্রজাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করে কোম্পানির বাৎসরিক আয় সুনির্দিষ্ট করার জন্য 1790 খ্রিস্টাব্দে আগামী দশ বছরের জন্য প্রচলন করেন 'দশসালা বন্দোবস্ত'।
চিরস্থায়ী ভূমিবন্দোবস্ত:
এরপর কোম্পানি ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পর 1793 খ্রিস্টাব্দের 22 মার্চ 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু' নামে নতুন এক ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত প্রচলন করে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যায়।
এই ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত অনুসারে জমিদারগণ নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে সম্পূর্ণ রাজস্ব প্রদান করলে তবেই জমিদারি স্বত্ব ভোগের অধিকারী হতেন। এই ব্যবস্থা অনুসারে স্থির হয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়েও রাজস্ব মকুব হবে না, জমিদারগণ ইচ্ছামতো জমিদান বা বিক্রয় ও বন্ধক রাখতে পারবেন।
মহলওয়ারি ভূমিবন্দোবস্ত:
1822 খ্রিস্টাব্দে এলফিনস্টোন ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ও গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে কিছু কিছু গ্রাম নিয়ে একটি মহল বা তালুক সৃষ্টি করে ইজারা দেওয়ার যে রীতির প্রচলন ঘটান তা মহলওয়ারি বন্দোবস্ত নামে পরিচিত।
রায়তওয়ারি ভূমিবন্দোবস্ত:
1820 খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার রিড ও টমাস মনরোর উদ্যোগে ভারতের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে যে ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় তা রায়তওয়ারি ভূমিবন্দোবস্ত নামে পরিচিত। এই বন্দোবস্ত 30-40 বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতো। এই বন্দোবস্ত অনুসারে কোম্পানি সরাসরি জমিদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
ভাইয়াচারি ভূমিবন্দোবস্ত:
1824 খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব সচিব ম্যাকেঞ্জি এবং এলফিনস্টোনের প্রচেষ্টায় পাঞ্জাবে যে ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্ত প্রচলিত হয় তা 'ভাইয়াচারি বন্দোবস্ত' নামে পরিচিত।
মূল্যায়ন:
ব্রিটিশ কোম্পানির আমলে প্রবর্তিত প্রতিটি ভূমিরাজস্ব বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য ছিল অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করা। তাই এই ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার ভয়ংকর ও ক্ষতিকারক প্রভাব লক্ষ করা যায় কৃষক সম্প্রদায়ের ওপর।