সাম্রাজ্যবাদ বলতে কী বোঝায়? সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণ লেখো।
উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের ধারণা আজকের নয়। অতি প্রাচীনকালেও ও এই ধারণা ছিল । তবে পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে নবজাগরণের সূত্রে ইউরোপের দেশগুলি নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার করার পর সেই সকল দেশগুলির উপর আগ্রাসন চালায় এবং সেখানে নিজেদের শাসন করতে উদ্যোগী হয়। এইভাবে আধুনিক যুগে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটে।
সাম্রাজ্যবাদ :
সাম্রাজ্যবাদের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে সাম্রাজ্যবাদ বলতে বোঝায় যখন কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র অর্থাৎ যেসকল রাষ্ট্র সামরিক শক্তিতে সমৃদ্ধ সেইসব রাষ্ট্র যখন কোনো দুর্বল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা হরণ করে এবং দখল করা দেশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তখন তাকে সাম্রাজ্যবাদ বলা হয়। সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ সমগ্র বিশ্বে বহু শতক আগে থেকে শুরু হলেও উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে চিরাচরিত সাম্রাজ্যবাদের চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।
সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণ:
খুব অল্প সময়ে নয় সাম্রাজ্যবাদী কার্যাবলি একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণ হিসেবে বলা যায়- রাজনৈতিক কারণ: সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভবের রাজনৈতিক কারণগুলি নিম্নরূপ-
রাজনৈতিক প্রতিপত্তি স্থাপন:
সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক প্রতিপত্তি স্থাপন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমগ্র বিশ্বদরবারে নিজ দেশের গৌরব বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি স্থাপনে প্রয়াসী হয়, যা ছিল সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের অন্যতম কারণ।
জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা:
জাতিগত প্রাধান্য বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকেও সাম্রাজ্যবাদের প্রেক্ষাপট প্রস্তুতের জন্য দায়ী করা যায়।
সামরিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য স্থাপন:
সামরিক ক্ষেত্রে প্রাধান্য স্থাপনকেও সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের জন্য দায়ী করা যায়। ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি নিজেদের সামরিক শক্তি জাহির করতে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে উপনিবেশ স্থাপনে আগ্রহী হয়েছিল।
সামাজিক কারণ:
সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভবের সামাজিক কারণগুলি নিম্নরূপ-
জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা :
অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে দুর্বল রাষ্ট্রগুলি দখল করতে প্রয়াসী হয়ে ওঠে যা সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ঘটায়।
উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার পুনর্বাসন:
ঊনবিংশ শতক থেকে সমগ্র বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সব রাষ্ট্রের কাছে এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি করে। এইসময় এই বাড়তি জনসংখ্যার পুনর্বাসন ও তাদের কর্মসংস্থানের জন্য সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব হয়েছিল বলে অনেক গবেষক মনে করেন।
অর্থনৈতিক কারণ:
সাম্রাজ্যবাদ উদ্ভবের অর্থনৈতিক কারণগুলি নিম্নরূপ-
বাজার দখলের প্রতিযোগিতা:
কিছু গবেষক ও ঐতিহাসিক মনে করেন উনিশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য প্রয়োজন ছিল বাজারের। এইসময় বাজার দখলের জন্য শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেছিল।
কাঁচামাল সংগ্রহ:
ঊনবিংশ শতকে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি ও বিজ্ঞানের প্রসারে গড়ে ওঠে নতুন যন্ত্রপাতি। এই নতুন যন্ত্রপাতি নিয়ে গড়ে ওঠে অজস্র কলকারখানা। এইসকল কলকারখানাতে শিল্পদ্রব্য প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজন হয় কাঁচামালের। আর এই কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য শক্তিশালী ইউরোপীয় দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে।
বেকারত্ব :
কলকারখানা স্থাপিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কুটির শিল্প বিনষ্ট হয় এবং কৃষিকার্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখা, খাদ্য সংকট ও বেকারত্বের চাপ বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
প্রযুক্তিগত কারণ:
বিভিন্ন গবেষক মনে করেন উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা, যন্ত্রচালিত যান ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের অভিযান স্পৃহা বৃদ্ধি করেছিল যা সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারণ বলে মনে করা হয়।
উপসংহার:
আধুনিক যুগেই উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ কথা দুটি প্রায় একই সঙ্গে উচ্চারিত হয় কারণ সাম্রাজ্যবাদের সাফল্য ও শেষ পর্যন্ত উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এই কারণে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ কথা দুটি একসঙ্গে যুক্ত হয়ে উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ ধারণার জন্ম দিয়েছে।