উপনিবেশবাদ বলতে কী বোঝায়? এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক নিরূপণ করো।

উপনিবেশবাদ: উপনিবেশবাদ শব্দটি ইংরেজি Colonialism শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ। Colonialism শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ Colonia থেকে, যার প্রকৃত অর্থ হলো বিশাল সম্পত্তি। উপনিবেশবাদের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে উপনিবেশবাদ বলতে বোঝায় যখন কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড দখল করে সেই স্থানে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এমার্সনের মতে-“ঔপনিবেশিকতা হলো কোনো বিদেশি জনগণের ওপর দীর্ঘ সময় ধরে শাসন প্রতিষ্ঠা এবং তা বজায় রাখার ব্যবস্থা।" আবার উইলসন ঔপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে বলেছেন-“ঔপনিবেশিকতা বলতে এমন ভূখণ্ডগত অধিকারকে বোঝায় যেখানে ইউরোপীয়দের ইচ্ছা ছিল বসবাসের জন্য নতুন স্থান লাভ করা।”

দ্বাদশ শ্রেনীর ইতিহাস

সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উপনিবেশবাদের সম্পর্ক :

 সাম্রাজ্যবাদের সাথে উপনিবেশবাদের কিছু পার্থক্য লক্ষ করা গেলেও ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে চিরাচরিত সাম্রাজ্যবাদের কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। আর সেই কারণে সাম্রাজ্যবাদের সাথে উপনিবেশবাদের কিছু সম্পর্কও রয়েছে। সেগুলি নিম্নরূপ-

 লেনিনের মতে: 

সাম্রাজ্যবাদের সাথে উপনিবেশবাদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে লেনিন তাঁর মতামত দিয়েছেন। লেনিন তাঁর লেখা 'Imperialism: The Highest Stage of Capitalism' গ্রন্থে বলেছেন-সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর। তিনি মনে করেন যেকোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র নিজ দেশের শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদের দ্বারস্থ হয়।

 হবসনের মতে:

 হবসন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উপনিবেশবাদের সম্পর্ক প্রসঙ্গে আবার ভিন্নমত দিয়েছেন। হবসন তাঁর লেখা 'Imperialism: A Study গ্রন্থে বলেছেন, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সমবণ্টনের অভাবে পুঁজিবাদী শ্রেণির হাতে প্রচুর মূলধন জমা হয়ে যায়। আর এই অতিরিক্ত মূলধন জন্ম দেয় সাম্রাজ্যবাদের।

 প্রযুক্তিগত প্রেক্ষাপট:

 প্রযুক্তিগত কারণের দ্বারস্থ হয়ে ড্যানিয়েল হেনরিখ, লিওনার্ড থম্পসন মনে করেন, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ সম্ভব হয়েছে উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা, যন্ত্রচালিত যান, বিশেষ করে প্রযুক্তিগত কারণে। তাঁদের মতে, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের উপনিবেশ গঠনের প্রাথমিক অভিযান থেকে শুরু করে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিটি স্তরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহায়ক হয়েছিল।

 অর্থনৈতিক কারণ:

 উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ক অনেকটাই নির্ভর করে অর্থনীতির ওপর। উপনিবেশ স্থাপন ও সাম্রাজ্যবাদের প্রধান কারণ বলা যায় অর্থনীতিকে। ইউরোপ মহাদেশের সকল শিল্পসমৃদ্ধ দেশ একদিকে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ ও অন্যদিকে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং সোনা, রূপা, দামি পাথর, মূল্যবান মশলা সংগ্রহের জন্য সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।

 খ্রিস্টধর্মের প্রচার:

 কিছু কিছু ঐতিহাসিক ও গবেষক মনে করেন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উপনিবেশবাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচারের হাত ধরে। তাঁদের মতে ইউরোপের খ্রিস্টধর্মের প্রচারকগণ আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয় ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাঁদের এই অভিযানের সাথে সাথে ইউরোপীয় দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়।

 ক্ষমতা প্রদর্শন: 

ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি বিশ্বদরবারে নিজ ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণের পথে পা বাড়ায়। ইউরোপের বেশিরভাগ রাষ্ট্রের সাম্রাজ্য বিস্তার যতটা না প্রয়োজন ছিল অর্থনৈতিক কারণে তার থেকেও বেশি ছিল দেশগুলির রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা। আর এই আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখেই সাম্রাজ্যবাদের সাথে উপনিবেশবাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

 সামরিক মর্যাদা বৃদ্ধি :

 ইউরোেপ মহাদেশের বেশ কিছু দেশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশ বিস্তারের পথে পা বাড়িয়ে ছিল নিজ দেশের সামরিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য। এই দেশগুলি এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে নৌ ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছিল, যা তাদের সামরিক শ্রীবৃদ্ধি করে সাম্রাজ্যবাদের পথে এগিয়ে যেতে সহায়ক হয়েছিল।

উপসংহার : 

উপরিউক্ত আলোচনায় স্পষ্ট, অষ্টাদশ শতকে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার তথা উপনিবেশ দখলের জন্য সর্বাধিক সচেষ্ট হয়েছিল ইউরোপের ছোটো-বড়ো শিল্প সমৃদ্ধ দেশগুলি। এশিয়া ও আফ্রিকার দুর্বল রাষ্ট্রগুলিতে তারা সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে উপনিবেশ স্থাপন করে, যার ফলাফল হয়েছিল খুবই শোচনীয়। একসময় যা সমগ্র বিশ্বকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
×