জাতিবৈষম্য বলতে কী বোঝায়? ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলিতে জাতিবৈষম্যের প্রভাবগুলি লেখো।
ঔপনিবেশিক সমাজে জাতি সংক্রান্ত প্রশ্ন ও তার প্রভাব আলোচনা করো। অথবা জাতিবৈষম্য বলতে কী বোঝায়? ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলিতে জাতিবৈষম্যের প্রভাবগুলি লেখো।
মানবসমাজে জাতি ও জাতিবৈষম্য একটি বিতর্কিত বিষয়। যেকোনো স্থানের জাতিগত প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে মনুষ্যজাতিকে গুণ, কর্ম, সক্ষমতা, গায়ের রং, নৈতিকতা, সাংস্কৃতিক আচার-আচরণ ইত্যাদির পার্থক্যের জন্য বিভক্ত করা হয়। পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলিতে জাতি, বংশ, ধর্ম, সম্প্রদায়, সামাজিক স্তরবিন্যাস ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে জাতিবৈষম্যের সূত্রপাত। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনে শাসিত জাতিগুলি নানান ধরনের বঞ্চনার শিকার হয়। এইসকল শ্বেতাঙ্গ শক্তিশালী জাতিগুলি নিজেদের প্রয়োজনে জাতিবৈষম্যের সূত্রপাত করেছিল।
ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলিতে জাতিবৈষম্য বা জাতিগত ব্যবধানের প্রভাব:
ইতিবাচক দিক:
জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার:
পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদী জাতিগুলি তাদের অধিকৃত উপনিবেশে নিজেদের সীমাহীন জাতিগত গৌরবের কথা প্রচার করে।
জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা:
সমগ্র বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জীবনধারণের উপকরণের ঘাটতি দেখা যায়। আর এই কারণেই জাতিগত সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এইসময় নিজ নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় জাতিগত বৈষম্য লক্ষ করা যায়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি:
প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির পথ সুপ্রশস্থ হয়। শুরু হয় ঔপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক উপনিবেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবন সম্পর্কে চর্চা এবং গবেষণা। ফলে নৃতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের গবেষণা বৃদ্ধি পায় এবং জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিকাশ ঘটে।
যুক্তিবাদের বিকাশ ও নবজাগরণের সূচনা:
পাশ্চাত্যের দেশগুলির বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাদানের উপনিবেশগুলিতে যুক্তিবাদের প্রসার ঘটে। ভৌগোলিক আবিষ্কার এবং সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটে যা যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটিয়ে নবজাগরণের পটভূমি তৈরি করে।
নেতিবাচক দিক:
ঔপনিবেশিক জাতিগত প্রশ্নের নেতিবাচক দিক নিম্নরূপ-
চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক:
ঔপনিবেশিক জাতিগত বিভেদের মাধ্যমে শাসকরা উপনিবেশগুলিতে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করত। এই শ্রমিকরা চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় তাদের জীবনে নেমে আসে চরম দুরবস্থা।
বিকৃত জাতীয়তাবাদ:
এই জাতিগত বৈষম্যের কারণে এক বিকৃত জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়। এর সাথে উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। এর প্রভাব পড়ে এশিয়া ও আফ্রিকার পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে।
সীমাহীন শোষণ ও অত্যাচার:
জাতিগত ব্যবধানের ফলে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলিতে শুরু হয় সীমাহীন শোষণ ও অত্যাচার। শ্বেতাঙ্গ শাসকরা কৃষ্ণাঙ্গ শাসিতের ওপর বিপুল পরিমাণে করের বোঝা চাপিয়ে দেয় নিজেদের আর্থিক মুনাফা লাভের আশায়। এভাবে দেশীয় শিল্পকে তারা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
জাতিগত দ্বন্দ্ব :
ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের মানুষদের ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে দেখত। তারা নিজেদের শ্বেতাঙ্গ জাতি ও শ্রেষ্ঠ জাতি বলে মনে করত। এতে শুরু হয় শ্বেতাঙ্গ শাসক ও কৃষ্ণাঙ্গ শাসিতের মধ্যে যুক্তিগত সংগ্রামের পরিবেশ।
উপসংহার:
এশিয়া ও আফ্রিকার পরাধীন জাতি গুলি সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর শাসন উপনিবেশের দরিদ্র জনগণ কোনদিন মেনে নিতে পারেনি। এর ফলে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং বিদ্রোহ দমনের নামে শুরু করে মানবিক নির্যাতন। যা কিছু বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে মর্মাহত করে এবং তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ উপনিবেশ স্বাধীন হতে থাকে।