লোককথা কাকে বলে? অতীত সময়কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে লোককথার ভূমিকা আলোচনা করো।
বিভিন্ন দেশ অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য ভাবধারাকে ভিত্তি করে লোককথাগুলি গড়ে ওঠে। মানুষের বাস্তব জীবন ঐতিহ্য সম্প্রদায়িকতা বৈশিষ্ট্য আচরণ অনুষ্ঠান প্রভুতি নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে কল্পনার সংমিশ্রণে লক্ষ্য কথাগুলি নির্মিত হয়। এরপর এগুলি বংশ-পরম্পরায় মানুষের মুখে মুখে চলতে থাকে।
লোককথা:
লোককথা একদিকে যেমন লোককাহিনি অন্যদিকে তেমনি বীরগাথা। কার্ল টমলিনসন ও ক্যারল লিঞ্চ ব্রাউন-এর মতে, “মানুষের জীবন ও কল্পনার সংমিশ্রণে যেসব গল্পগাথা গড়ে উঠেছে তা-ই হলো লোককথা।" অতীত সময়ের ঘটনাবলি তুলে ধরার ক্ষেত্রে লোককথা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। লোকমুখে প্রচলিত কথাই সাধারণত লোককথা নামে পরিচিত। প্রাচীন কালে কাব্য গেয়ে জীবিকা অর্জন করত কথকরা। তাদের কথকতা থেকে প্রাচীন কাব্যের অসংখ্য গল্প লোকসমাজে প্রচলিত হতো। লৌকিক কাহিনি নিয়ে গড়ে ওঠা এইসব গাথা, বীরগাথা, রূপকথা ও পশুকথাকে বলা হয় লোককথা।
লোককথার বৈশিষ্ট্য
কেন্দ্রীয় চরিত্র: লোক কথার কেন্দ্রীয় চরিত্র হল মানুষ।মানব সমাজের নানা ঐহিত্য বা ঘটনাবলীর উপর ভিত্তি করে এগুলি রচিত হয়। সাধারণত লোক কথা গুলি মানব সমাজের বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণ।
কল্পনাধর্মিতা: লোককথা চরিত্রগুলি বাস্তবধর্মী নয়, কাল্পনিক। লোককথা গুলি জীবন ধর্মী হলে ও এখানে গাছ, পশুপাখি, ডাইনি, দেবদূত প্রভৃতি কাহিনী চরিত্র হিসাবে ফুটে ওঠে এবং কল্পনা শক্তির মাধ্যমে বাস্তবগাহ্য করে তোলে।
জনপ্রিয়তা : বস্তত লোককথা গুলি কল্পনাধর্মী হওয়ার কারণে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এবং বহু যুগ ধরে তাদের নতুনত্ব এবং আকর্ষণ একই ধারা অব্যাহত রয়েছে। পশুপাখি, দেবদূত ,ডায়নি প্রভৃতি কল্পনাভিত্তিক চরিত্র ও লোককথা গুলিতে আরো জনপ্রিয় লাভ করতে সাহায্য করেছে।
অতীত সময়কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে লোককথার অবদান :
প্রথমত, সমাজজীবনে চলার পথে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রায় প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে লোককথা যথেষ্ট শিক্ষাদান করে, যা অতীত ইতিহাসকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সমাজে নানান ঐতিহাসিক কাহিনির অনুকরণে বিভিন্ন লোককথার প্রচলন ঘটতে দেখা যায়, যা থেকেই ওই সমাজের ঐতিহাসিক ধাঁচ সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়।
তৃতীয়ত, লোককথার কাহিনিতে মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন ভৌতিক চরিত্র যেমন-পরি, দৈত্য, ডাইনি প্রভৃতি থাকে। মানুষের সামনে লোককথা এইসব ভৌতিক চরিত্রকে তুলে ধরতে সাহায্য করে।
চতুর্থত, লোককথা থেকে অতীত সমাজের বিভিন্ন ঘটনার ছবি বর্তমান সমাজে লক্ষ করা যায়। কারণ লোককথা বিভিন্ন সামাজিক, ঐতিহাসিক ঘটনার অনুকরণ করে থাকে।
পঞ্চমত, লোককথার মাধ্যমে মানুষ অতীতের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে শুনে আনন্দ পেয়ে থাকে। এই আনন্দ যুগ যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে লক্ষ করা যায়।
ষষ্ঠত, লোককথা কল্পজগৎ সৃষ্টি করে আমাদের অতীতের প্রতি আগ্রহী করে। নিত্যদিন এই লোককথা কথিত হয় কিন্তু পুরনো হয় না। এর নতুনত্ব বজায় থাকে।
সপ্তমত, ছোটোবেলা থেকেই মানুষ বিভিন্ন পৌরাণিক গল্পগাথা বড়োদের মুখে শুনে থাকে। কিছু কিছু ঘটনা বা গল্প মানুষের মুখে মুখে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে। আর এইভাবেই লোককথা অতীত ইতিহাসকে তুলে ধরতে সাহায্য করে।
অষ্টমত, কোনো দেশের কোনো সমাজে সৃষ্টি হওয়া লোককথা সেই সমাজের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। ফলে সেই সমাজের সামাজিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য কেমন ছিল তা লোককথা থেকে জানা যায়।
উপসংহার :
লোককথাগুলি কাল্পনিক ও অলিখিত হয়, ফলে দুটি ক্ষেত্রে ভুল তথ্য প্রদানের সম্ভাবনা থেকে যাই তবু ইতিহাসের কোন সন্তানের এগুলোর গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করা যায় না।