বাংলা প্রবন্ধ রচনা - বাঙালির উৎসব
ভূমিকা : বার মাসে তেরো পার্বণের দেশ বাংলা। বাংলার উৎসবের মধ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে বাঙালির জীবনবোধ। এই উৎসবের মধ্যে দিয়েই বাঙালী নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে অপরের মধ্যে এবং অপরকে গ্রহণ করেছে নিজের অন্তরে। বাংলার উৎসবকে ঘিরে কত কবি কবিতা রচনা করেছেন। বাংলার উৎসবের আসল চেহারাটি ধরা পড়েছে বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমের আঁচড়।
“আমার আনন্দে সকলের আনন্দ হোক/ আমার শুভে সকলের শুভ হোক, আমি যাহা পাই তাহা পাঁচজনের সহিত মিলিত হইয়া উপভোগ করি -এই কল্যাণী ইচ্ছাই/ উৎসবের প্রাণ”
উদ্দেশ্য : বাঙালির উৎসবের উদ্দেশ্য হল প্রীতি ও প্রেমের পূর্ণ বন্ধন। আমার ভালোর সঙ্গে সঙ্গে আরো পাঁচজনের ভালো হোক এটাই উৎসবের প্রাণ। উৎসব মানে সুখ, দুঃখকে সকলে ভাগ করে নেওয়া। বৈচিত্র্যের মধ্যে আনন্দ উপভোগ করা, উৎসব মানে সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি। উৎসবের উদ্দেশ্য হল সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বাণী সকলের মধ্যে প্রচার করে বাঙালির মনকে সতেজময় কোরে তোলা
উৎসবের নানা রূপ: বাঙালির জীবনে উৎসব নানা রং নিয়ে আসে। ধর্মীয় উৎসবের রং আর ঋতু উৎসবের রং এক নয়। তেমনি সামাজিক উৎসব সাংস্কৃতির উৎসব বা জাতীয় উৎসবে প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা রং স্বাদ বা মেজাজ নিয়ে আসে বাঙালির মনের দরজায়। আর এই উৎসবের মধ্য দিয়েই বাঙালি অভাব-অনটনের মধ্যেও খুঁজে নেয় প্রাণের রসদ।
ধর্মীয় উৎসব : বাংলায় নানা ধর্ম ও আরাধনার পীঠস্থান। এখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি নানা ধর্মের মানুষ বসবাস করে এই বাংলাদেশে। হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবগুলির মধ্যে সিদ্ধিদাতা গনেশ পূজার মধ্য দিয়ে ঘটে বর্ষা আরম্ভের সূচনায়। তারপর রথযাত্রা, রাখি পূর্ণিমা, মনসা পূজা, বিশ্বকর্মা পূজা শেষ হতে না হতে চলে আসে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা। শরতের হিমেল পরিবেশে প্রকৃতির রূপসজ্জার সঙ্গে সঙ্গে মা দূর্গা ছোটো ছোটো মনকে নব সাজে সজ্জিত করে তুলে বাঙালির জীবনকে। তার পর আসে অমাবস্যার তিথিতে শ্যামা মায়ে পূজা। সারি সারি প্রদীপের আলোয় অন্ধকার রাত্রিতে যেন স্বর্গীয় পরিবেশে রচনা করে। পরবর্তীতে কার্তিক পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা এবং তারপরেই স্কুল কলেজে, পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয় সরস্বতী বন্দনা। রাত্রিতে যেন স্বর্গীয় পরিবেশ রচনা করে। পরবর্তীতে কার্তিক পূজা, জগধাত্রী পূজা এবং তার পরেই স্কুল কলেজে, পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয় সরস্বতী বন্ধনা। হিন্দুদের এই উৎসবগুলি ছাড়াও মুসলিমদের ঈদ, মহরম, সবেবরাত, খ্রিষ্টানদের বড়দিন, বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা প্রভৃতি উৎসব বাঙালির জীবনকে প্রাণময় করে তোলে।
সামাজিক ও ঋতু উৎসব : বাঙালী শুধু ধর্মীয় আবেগ প্রবণ জাতি নয় সেই ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে গিয়েছে তার নানা পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান। যেমন – অন্নপ্রাশন, বিবাহ, জামাইষষ্ঠী, ভাতৃদ্বিতীয়া। দৈনন্দিন জীবনের নানা প্রয়োজনের সঙ্গে জড়িত এই উৎসবগুলিতে সমগ্রভাবে গোটা বাঙালি সমাজ যুক্ত না হলেও বহু মানুষই এগুলিকে ঘিরে আনন্দে মেতে ওঠে। নানা ঋতুকে ঘিরেও উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি। বর্ষামঙ্গল, পৌষমেলা, নবান্ন, নববর্ষের মতো নানা ঋতু কেন্দ্রিক উৎসবের মধ্য দিয়ে দুঃখ দারিদ্র্য, অভাব পীড়িত বাঙালি নতুন করে নব আনন্দে জেগে ওঠে।
জাতীয় উৎসব : জাতীয় উৎসবের মধ্যে পড়ে স্বাধীনতা দিবস, ২৩ জানুয়ারী, ২৬ জানুয়ারী ও ২রা অক্টোবর গান্ধীজীর জন্মদিন। ২৫শে বৈশাখ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রবীন্দ্রজন্ম জয়ন্তী উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। এছাড়া রাজনৈতিক নেতা, মনীষীও সাহিত্যিকদের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
উপসংহার : উৎসবের মানে নগ্ন আনন্দ উচ্ছ্বাস নয়, উৎসব মানে বহিরঙ্গাবিলায় নয়, নয় অশালীনতা, উৎসব মানে প্রকৃত স্বর্গীয় পরিবেশ রচনা করা। উৎসব মানে প্রেম, উৎসব মানে বিবেক, উৎসব মানে মনুষ্যত্বের জাগরণ। কবির কথায় -
প্রীতি প্রেমের পূণ্য বাঁধনে। যবে মিলি পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন
আমাদের কুঁড়ে ঘরে।
— কামিনি রায়