বাংলা প্রবন্ধ রচনা - বাংলার ঋতু চক্র অথবা বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য
ভূমিকা : আমাদের প্রকৃতি বড়ই বিচিত্র ছন্দময় তার গতিধারা। ছন্দে ছন্দে কেটে যায় দিন। দিনের পর আসে রাত, রাত্রি শেষে আবার দিন এইরকম ভাবেই কাটে মাস। মাসে মাসে পূর্ণ হয় বছর। কিন্তু বছরের সবকটি দিন একরকম যায় না। এই বৈচিত্র্য অনুযায়ী সমগ্র বছরকে ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে “গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত।”
প্রকৃতির আচরণ : প্রকৃতি বড়ই হিসেবী। সে চায় না তার বৈচিত্র্যের সম্ভার একেবারে ঢেলে দিতে। তাই তার সম্ভাবর সে বিতরণ করে ছয়টি ঋতুর মধ্য দিয়ে। এই ছয়টি ঋতু যেন আমাদের কাছে প্রকৃতির উপহার। প্রকৃতি যেন নিজের খেয়ালে মেতে ওঠে আমাদের কখনও বা সুখে সম্পদে পূর্ণ করে তোলে আবার কখনও বা দুঃখময় জীবনের দিকে ঠেলে দেয়।
গ্রীষ্ম : গ্রীষ্ম ঋতুর মধ্য দিয়েই প্রকৃতির যাত্রা শুরু হয়েছে। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস গ্রীষ্ম ঋতুর অধীন। সূর্যের প্রচন্ড তাপ প্রবাহের ফলে পৃথিবীতে নেমে আসে মরুভূমির কঠিন কঠোর শুষ্ক আবহাওয়া। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায়-
দারুণ অগ্নিবানে
হৃদয় তৃয়া হাতে
রজনী নিদ্রাহীন দীঘ দগ্ধ দীন”।
প্রকৃতির এই দগ্ধতা মৃদুমন্ত বাতাস অনেকটাই কমিয়ে দেয়। এই সময় কালবৈশ পীর ঝড় তার প্রচন্ড ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠলেও তার মধ্যেই আমরা শুতে পায় সৃষ্টিসুখের গোপন বার্তা। ফুল ফোটানোর এই ঋতুর দায়িত্ব নয়। ফল ফলানোতেই তার আনন্দ । গ্রীষ্ম তাই ফলের ঋতু। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি রসালো ফলে প্রকৃতির ডালি এই সময় পূর্ণ থাকে।
বর্ষা : গ্রীষ্মের পর বর্ষা তার শ্যামলী রূপ নিয়ে অবতীর্ণ হয়। আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। মেঘ মেদুর আকাশের স্নিগ্ধ গাছের পাতায় পাতায় সবুজের ঢেউয়ের বাধন ধারা বর্ষন, বাতাসের দূরন্ত কণা সব মিলিয়ে আসে বর্ষা। কবি গেয়ে ওঠেন—
হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে
ময়ুরের মতো নাচে রে।”
নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা বন্দনা করি বর্ষাকে। যেমন স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলন যাত্রা, মনসার ভাসান ইত্যাদি নানারকম পালাপার্বণে মেতে ওঠে পল্লী প্রকৃতি।
শরৎ: বর্ষা আমাদের হাসিয়ে কাঁদিয়ে বিদায় দেয়। এরপর উৎসব প্রায় বাঙালির কাছে স্থান করে নেয় ঋতু রাণী শরৎ। ভাদ্র ও আশ্বিন এই দুই মাস তার অবস্থান কাল। প্রকৃতিতে লাগে নতুন রুপের ছোঁয়া, মন ভোলানো রূপ দেখে কবি গেয়ে ওঠেন-
“তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে
জানি না কি মরণ নাচে গেয়ে এ চরণ ভুলে ”
এই সময় মাঠে মাঠে দেখা যায় কাশ ফুলের সাদা প্রকৃতি। শিউলি ফুল ছড়ায় তার গন্ধ, অপরাজিতা বিস্তার করে তার রঙের বাহার। শারদীয়া দুর্গা উৎসব মানুষের জীবনকে নতুন রঙে রাঙিয়ে দেয়। উৎসবের বার্তা নিয়ে আসেন মা লক্ষ্মী, কোনো কোনো বছর মা কালীকেও ডেকে নিয়ে আসে শরৎ।
হেমন্ত : শরৎ হেমন্তের উপর সব দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নেয়। কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাস শীতের আগমনের পথ রচনা করে হেমন্ত। এই ঋতু নিজের অঙ্গসজ্জায় বড়ই
উদাসীন তাই রবীন্দ্রনাথ হেমন্ত লক্ষ্মীর বন্দনায় বলেছেন-
“হায় হেমন্ত লক্ষ্মী তোমার নয়ন কেন ঢাকা
হিমের মন ঘোমটা খাবি
ধুমড়ো রঙে আঁকা”
হেমন্তের দায়িত্ব গৃহস্থের হারে ফসল তোলা। তাই হেমন্ত শস্যের ঋতু। নবান্ন উৎসবে মাতিয়ে তোলে এই ঋতু পল্লী প্রকৃতিকে।
শীত : হেমন্তের পর আসে শীতের পালা। কাউকে কষ্ট দিয়ে আবার কাউকে সুখে পরিপূর্ণ করে শীত। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস দাপিয়ে রাজত্ব করে বিদায় নেয়। শীত ঋতু নানা রকমের শাক সব্জির পসরা হাজির করে আমাদের কাছে। বাঙালি পিঠেপুলি উৎসবে মেতে ওঠে।
বসন্ত : শীতের বিদায়ের পর বসন্ত তার রূপের ডালা সাজিয়ে হাজির হয় প্রকৃতিতে। ফাল্গুন, চৈত্র এই দুই মাস ফুলে ফলে পাখির গানে মাতিয়ে রাখে সে। প্রকৃতির রূপসজ্জার সাথে সাথে মানুষের মনেও রচিত হয় নতুন স্বপ্ন, নতুন আশা। বসন্ত বন্দনায় মেতে ওঠে যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী সকলে । শ্রী পঞ্চমী আর দোল উৎসব মানুষের মনে আনন্দের জোয়ার এনে দেয়। উপসংহার : বাংলার ঋতুচক্রের আনন্দ, বেদনা, হাসি, কান্নার মধ্যে আমরা বঙ্গবাসী বেঁচে আছি। বারে বারে তারা আসে আবার চলে যায়। তারই মধ্যে আমরা গড়ে তুলি নিবিড় সম্পর্ক গুলি। বৈচিত্র্যের মধ্যে যেন ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে আমরা মিলে মিশে বাস করছি। এরকমই এক সৌন্দর্য বিকশিত আমাদের প্রকৃতি রানী।