বাংলা প্রবন্ধ রচনা - কন্যাশ্রী প্রকল্প
ভূমিকা : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল লক্ষই হল— প্রজাকল্যাণ সাধন। সমাজে আর্থিক বৈষম্য দূর করা। শিক্ষা এবং খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকারকে নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সরকারের পরিকল্পনা তৈরি হয়। এইসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই। ২০১৩ সালে প্রবর্তিত ‘কন্যাশ্রী প্রকল্প' এই উদ্দেশ্য সাধনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রকল্পের নিয়ম, উৎস ও বাস্তবতা : কন্যাশ্রী প্রকল্প অনুসারে যেসব পরিবারের বাৎসরিক আয় ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা বা তার চেয়ে কম সেই পরিবারের ১৩ থেকে ১৮ বছরের ছাত্রীরা বছরে ৫০০ টাকা করে (এখন বেড়ে হয়েছে ৭৫০ টাকা) বৃত্তি পাবে। যদিও অনাথ বা প্রতিবন্ধী ছাত্রীদের ক্ষেত্রে আয়ের কোনো উর্দ্ধসীমা নেই।
শিক্ষার মূলস্রোতে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে গেলে এই ছাত্রীরা ১৮ বছর বয়সে পাবে এককালীন ২৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ কোনো মেয়ের উচ্চশিক্ষা লাভের লক্ষ পূরণের জন্য সরকার তার পাশে দাড়াবে। এই প্রকল্পের জন্য এখন রাজ্য সরকারের বছরে খরচ হচ্ছে ৮৫০ কোটি টাকা। আগামী বছরগুলিতে এই ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধির সম্ভাবনাই আরও বেশি। রাজ্যের প্রায় ২০ লক্ষ ছাত্রী এই সুবিধা পাচ্ছে। এই প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর থেকে সংখ্যাটা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। ভারতের মতো দেশে নারী শক্তির এই অবমাননার মূল কারণ হল সীমাহীন দারিদ্র। আর্থিকভাবে অনগ্রসর এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই শিক্ষার সামর্থ্যে পিছিয়ে পড়া কিন্তু যিনি বা যারা পিছিয়ে, দোষটা তাদের নয়? দোষটা রাষ্ট্রেরও সমাজের। সম্পদ বন্টন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থেকেই সমাজে ক্রমাগত আর্থিক অসাম্য বাড়ে। কোটি কোট মানুষকে অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র করে রাগে যে উন্নয়ণ সেই উন্নয়ণ গণতন্ত্রের কাম্য নয়। তাছাড়া বড়ো অংশের মানুষ উন্নয়ণের সুফল থেকে বঞ্চিত হলে সমাজে অশান্তি, হিংসা ক্রমশই বাড়বে। এখন সমাজ বিজ্ঞানীরা এমনটাই মনে করেন। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার বিভিন্ন লেখায় এবং বক্তৃতায় বলেছেন, পিছিয়ে থাকা মানুষকে উন্নয়ণের শরীক করলে তবেই গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়, আর গণতন্ত্র শক্তিশালী হলেই পিছিয়ে থাকা মানুষ উন্নয়ণের সুফল লাভ করে।
তাই এই দুটো কাজ একসঙ্গে করতে হবে। ‘কন্যাশ্রী' প্রকল্প যেন সেই যাত্রার দিকে একটি ছোট্ট পদক্ষেপ। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা জরুরি, বছরে ৫০০ টাকা হয়তো খুব বিরাট অঙ্কের টাকা নয়। কিন্তু সেই টাকাকা ও যে ছাত্রীর প্রাপ্য, তারজন্যই খরচ করা হচ্ছে কিনা সেই ব্যাপারেও একটি সরকারি নজরদারি থাকা জরুরি। ১৮ বছরের কন্যাকেও যখন সরকার ২৫ হাজার টাকা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে দেবে, সেখানেও এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের মেয়েদের শুধু অধিকার দিলেই হবে না তা রক্ষা করা হচ্ছে কিনা, সেটা দেখাও সরকারের দায়িত্ব। উল্লেখ্য নারী শিক্ষা ও নারী প্রগতির স্বার্থে সরকার যখন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এ জনমানসে তার একটি সদর্থক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
উপসংহার : কন্যাশ্রী প্রকল্প শুধু দেশের মধ্যে নয়, গোটা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সরকারের খেয়াল রাখা উচিত তা যেন নজরদারির অভাবে ব্যর্থ না হয় এবং অবশ্যই বার্ষিক ব্যয়-বরাদ্দের পরিমাণ আরও কিছুটা বাড়ালে ভালো হয়। কন্যাশ্রী প্রকল্পর ফলে সুফল কতটা, ফলন, মাঝপথে স্কুলছুটের সংখ্যা কতটা কমল বাড়ল বিবাহ কতটা রোধ হল তা বিচারের সময় এখনও আসেনি। তবে প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে অনেকেই মনে করছেন, পরিবর্তন চোখে পড়তে, কমছে স্কুল-ছুটের প্রবণতা। তাই এই প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে রূপায়িত হলে সুফল পাওয়া যাবে, সমাজের বিরাট সংখ্যক পিছিয়ে পড়া অংশের মেয়ের সুদূর ভবিষ্যতে নিজের ভাগ্য নিজেই নির্ধারণ করবার অধিকার অর্জন করবে,এমনটা আশা করাই যায়।