বাংলা প্রবন্ধ রচনা - লেখক ও পাঠকের মিলন সেতু: বইমেলা(PDF)
ভূমিকা : সভ্য মানুষের জীবনে অপরিহার্যরূপে জড়িয়ে গেছে বই। লিপি আবিষ্কারের পর থেকে মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা কিংবা অনুভূতিগুলিকে ধরে রাখতে চেয়েছে বইয়ের মধ্যে। ক্রমে, ক্রমে অনেক সমৃদ্ধি ঘটেছে। গড়ে উঠেছে ছোট বড় অজস্র গ্রন্থাগার, বই নিয়ে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের ও একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। সংস্কৃতি জ্ঞানচর্চা আর বাণিজ্যের সেই মেলবন্ধনেই সৃষ্টি হয়েছে বইমেলার।
বইমেলার সূচনা ও স্বরূপ : খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতকে স্টুরবিজে সম্ভবত অনুষ্ঠিত হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম বইমেলার। এরপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শহরে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এদের মধ্যে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট শহরে অনুষ্ঠিত বইমেলার উল্লেখ না করে থাকা যায় না। তবে যথার্থ বইমেলা জার্মানির লাইপৎসিঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। ধীরে ধীরে তা পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
এদেশে বইমেলা : অন্য দেশের দেখাদেখি এদেশের মাটিতে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতার মার্কস স্কোয়ারে যে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন হত, সেখানেই ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজন করেছিলেন বঙ্গীয় পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। তবে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের আয়োজনে মুম্বাই শহরে ১৯৬৯ খ্রিস্টাবদে যে বইমেলা হয় সেটা প্রদেশের প্রথম যথার্থ বইমেলা। পাবলিশার্স এ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড-এর উদ্যোগে তারামন্ডলের সামনের মাঠে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে যে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় সেটাই ছিল কলকাতার পুস্তকমেলার প্রথম ।
লেখক প্রকাশক ও পাঠকের ত্রিবেণী সঙ্গম : বইমেলা জ্ঞানের মেলা, ভাবের মেলা ও আনন্দের মেলা ৷ বইমেলায় ঘটে লেখক প্রকাশক ও পাঠকের ত্রিবেণী সঙ্গম। এখানে এই জ্ঞানের হাটে,ভাবের হাটে বিকিকিনির উদ্দেশ্যে সবাই সমবেত হয়। কেবল আঞ্চলিক ভাষায় নয়, সকল ভারতীয় ভাষায় এমনকি আন্তর্জাতিক ভাষায় বইয়ের প্রকাশকরাও এখানে অংশগ্রহণ করেন।
বইমেলার খুঁটিনাটি বিষয় : বইমেলা সাহিত্য, নাটক, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, নৃতত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, প্রযুক্তিবিদ্যা থেকে আধুনিক রন্ধনশিল্প, খেলাধূলা ইত্যাদি বিষয়ের বহু বিচিত্র পুস্তকের সমাবেশে ঘটে এখানে। তবে কলকাতায় অকস্মিত বলে বইমেলায় বাংলা বইয়ের সেই সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের প্রাধান্য সমধিক।
বইমেলা জেলায় জেলায় : বইমেলার ঐতিহ্য এখন জেলায় জেলায় সম্প্রসারিত হয়ে গেছে। বইমেলা সেই দিক থেকে বাংলার সংস্কৃতির এক গৌরবময় অহংকার। এখানে লোক সমাগমও বিস্ময়কর। কিন্তু ১৯৯৭ সালের ৩ রা ফেব্রুয়ারী বাংলা বইমেলার এক কলঙ্কময় ও বেদনাবহ “কালা দিবস”। ঐদিন এক ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ডে কলকাতায় বাংলার এই সংস্কৃতির অগ্নিকান্ডে ভস্মীভূত হয়। তাতে সর্বসাধারণের যে সহানুভূতি বর্ষিত হয়, তাও অবিস্মরণীয় ।
বইমেলার সাফল্য : জেলা বইমেলা এবং কলকাতার বইমেলায় গ্রন্থপ্রেমী মানুষের ভিড় উপচে পড়ে। বইমেলায় এই স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাগম বইমেলায় সাফল্যের কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। বইমেলাও মানুষের একটি মহামিলনের ক্ষেত্র। এখানে জাতি-ধর্ম-বিত্ত নির্বিশেষে মানুষ মিলিত হয়। এখানে একাকার হয়ে যায় গ্রাম-শহর।
উপসংহার : বই মানুষের সবসময়ের সবচেয়ে সুন্দর সঙ্গী। বই দূরকে করে নিকট এবং পরকে করে আপন। আর বইমেলায় সে মননের উত্তাপ নিতে প্রচুর মানুষ ভিড় জমায়। কসমেটিক সংস্কৃতির বাজারে, চিরুণি সভ্যতার যুগে বইমেলা দিন দিন তার গৌরব বৃদ্ধি করে চলেছে। এই গৌরব ক্রমবর্ধমান হোক এটাই আমাদের কাম্য।