মাধ্যমিক বাংলা কবিতা - প্রলয়োল্লাস( নজরুল ইসলাম) এর সমস্ত প্রশ্ন ও উত্তর।
“বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে”- বজ্রশিখার মশাল আসলে কী ? মশাল জ্বেলে কার আগমনের কথা বলা হয়েছে?
উ : দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক কাজী নজরুল ইসলামের 'প্রলয়োল্লাস' গীতিকায় উল্লিখিত 'বজ্রশিখা' হলো বজ্রের আগুন'। তাই বজ্রশিখার মশাল' বলতে বজ্রের আগুনের মতো সর্বনাশী ভয়ংকর মশালের আগুনের কথা বলা হয়েছে। এই আগুনে সমস্ত অরাজক পরিস্থিতির অবসানের পর নবসৃষ্টি ঘটবে। আলোচ্য কবিতায় বজ্রশিখার মশাল জ্বেলে ভয়ংকরের আগমনের কথা বলা হয়েছে। এই ভয়ংকর আসলে নবীন বিপ্লবী দল।
‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?' কবি ধ্বংস দেখে কেন ভয় পেতে নিষেধ করেছেন ? অথবা ‘ভাঙা-গড়ার খেলা যে তার কীসের তবে ডর'—'ভাঙা-গড়ার খেলাটি কী? তা থেকে বক্তা কেন ভয় পেতে নিষেধ করেছেন? অথবা ‘মাভৈঃ মাভৈঃ' –কবি কেন ভয় পেতে নিষেধ করেছেন? অথবা, ‘প্রলয়নতুন সৃজন-বেদন’– এ মন্তব্যের কারণ কী? অথবা, 'প্রাণ-লুকানো ওই বিনাশে'–এ মন্তব্যের কারণ কী? অথবা 'নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়’–উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য লেখো।
উত্তর : উৎস : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত 'অগ্নিবীণা' কাব্যের অন্তর্গত প্রলয়োল্লাস কবিতা থেকে প্রদত্ত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
মন্তব্যের কারণ : সৃষ্টির উন্মেষ ধ্বংস। ধ্বংসের মধ্যে দিয়েই জীর্ণ-জরা দূরে সরে নবচেতনার জাগরণ ঘটে। প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস ‘পাতা ঝরা নয়, পাতা গড়ার মুহূর্ত'। প্রলয়ের প্রচণ্ডতা আসলে নবনির্মাণেরই পূর্বাভাস। প্রলয়রূপী কালবৈশাখীর মহাতাণ্ডবে সিক্ত মৃত্তিকাই নবঅঙ্কুরোদ্গমের ভিত্তিভূমি। কবির মতে, প্রলয় হল নতুন সৃষ্টির বেদনা মাত্র। যেহেতু ধ্বংসের মধ্যেই নিহিত থাকে সৃষ্টির বীজ, তাই তিনি ধ্বংসের প্রচণ্ডতা দেখে ভয় পেতে নিষেধ করেছেন।
সর্বনাশী জ্বালামুখী ধূমকেতু"- সর্বনাশী জ্বালামুখী বলা হয়েছে কেন? ধুমকেতু বলতে কী বোঝো?
উ.: বিদ্রোহী কবি কাজী নজবুল ইসলাম 'প্রলয়োল্লাস' গীতিকায় 'ভয়ংকর' এর রূপ বর্ণনা প্রসঙ্গে সর্বনাশী জ্বালামুখী শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। অনেকের ধারণা ধূমকেতু সমকালের ইতিহাস বহন করে যার দ্বারা সর্বনাশ ঘটে। তাই 'সর্বনাশী আবার ধূমকেতুর পুচ্ছে জ্বালা বা অগ্নিশিখা থাকে বলে একে জ্বালামুখী বলা হয়েছে।
আকাশে কখনো কখনো যে জ্যোতির্ময় পদার্থ সুবৃহৎ কাঁটার ন্যায় অংশ বিস্তার পূর্বক উদিত হয় তাকে ধূমকেতু বলে। অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের মতো ধূমকেতুও একটি নির্দিষ্ট পথে নিয়মিতরূপে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
বিধুরা প্রদীপ তুলে ধর’—বধূদের কেন প্রদীপ তুলে ধরতে বলা হয়েছে? অথবা ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর'—কবি কেন জয়ধ্বনি করতে বলেছেন?
উত্তর : উৎস : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘অগ্নিবীণা' কাব্যের অন্তর্গত প্রলয়োল্লাস কবিতা থেকে প্রদত্ত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
মন্তব্যের কারণ : সৃষ্টির উন্মেষ ধ্বংসে। ধ্বংসের মধ্যে দিয়েই জীর্ণ-জরা দূরে সরে নবচেতনার জাগরণ ঘটে। প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস ‘পাতা ঝরা নয়, পাতা গড়ার মুহূর্ত'। প্রলয়রূপী কালবৈশাখীর মহাতাণ্ডবে সিক্ত মৃত্তিকাই নবঅঙ্কুরোদগমের ভিত্তিভূমি। কবির মতে, হল নতুন সৃষ্টির বেদনা মাত্র। যেহেতু, পুরাতন সব ধ্বংস হলেই নতুনের সূচনা হবে, কবি প্রলয়কে স্বাগত জানিয়ে উল্লাস করতে বলেছেন/ বাংলার বধুদের প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে। প্রলয়কে বরণ করে নিতে বলেছেন। প্রলয় তাই
“আসছে নবীন”, নবীন বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে? পঙক্তিটির মধ্যে দিয়ে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করো।
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত 'অগ্নিবীণা' কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা 'প্রলয়োল্লাস'। কবি আয় 'নবীন' বলতে বোঝাতে চেয়েছেন দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমুক্ত করার তরুণ বিপ্লবীদেরকে। স্বাধীনতাও সমাজরুপান্তরের জন্য কবি নবীন বিপ্লবী শক্তির আগমন প্রত্যক্ষ করেছেন। তারা দেশের দুর্দিনে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে ভয়ংকরের রূপে আবির্ভূত হয়ে প্রলয় ঘটালেও আসলে তারা মঙ্গলা কাজী, সত্য, শিব ও সুন্দরের পূজারি। কিন্তু সেই প্রলয়ের মধ্যেই রয়েছে সৃজনের সম্ভাবনা। ভাঙার মধ্য দিয়ে গড়ার প্রতিশ্রুতি থাকে। ধ্বংস যদি নাই হয়, তবে সৃষ্টি কোনোদিন সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে না। চির সুন্দরের এভাবেই আবির্ভাব ঘটে। সে কারণে নবীণের এই ধ্বংসোন্মত্ততা আসলে জীবন বিমুখ অসুন্দরকে দূর করার জন্য।
“আসছে এবার অনাগত প্রলয় নেশার নৃত্য পাগল”— প্রলয় নেশার নৃত্য পাগল বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে? পংক্তিটি সপ্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করো।
উ.: বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'প্রলয়োল্লাস' কবিতায় প্রলয় নেশার নৃত্য পাগল বলতে বোঝাতে চেয়েছেন দেবাদিদের মহাদেবকে, যিনি রক্ষক ও সংহারক।পরাধীনতার যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-বনা এসব থেকে মুক্তির জন্য মানুষের সংগ্রাম ক্রমশই তীব্রতর হচ্ছিল। সেই সংগ্রাম ধ্বংসকে নিশ্চিত করে। নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর তরুণ বিপ্লবী প্রাণদের দেখলে মনে হয় তাঁরা যেন 'প্রলয়' নেশার 'নৃত্য পাগল'। সমুদ্রপারে সিংহ দরজার আগল ভাঙাই তাদের প্রধান লক্ষ। কালবৈশাখীর ঝড়ে তারা প্রগতিশীলতার পতাকা উড়িয়ে দেয়। এদেরই জয়ধ্বনি করার জন্য কবি আহ্বান করেছেন।
‘এবার মহানিশার শেষে, আসবে ঊষা অরুণ হেসে’– 'মহা নিশার শেষে' বলতে কী বোঝানো হয়েছে? সম্পূর্ণ উক্তিটির তাৎপর্য লেখো।
উত্তর : উৎস : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘অগ্নিবীণা' কাব্যের অন্তর্গত প্রলয়োল্লাস কবিতা থেকে প্রদত্ত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
প্রলয় দেবতা পুরাতনের ধ্বংসলীলায় মত্ত। এই ধ্বংসলীলার পরিসমাপ্তিকেই কবি ‘মহানিশার শেষ’ বলে অভিহিত করেছেন। ■ প্রলয়ের প্রচণ্ডটা আসলে নবনির্মাণেরই পূর্বাভাস। প্রলয়রূপী কালবৈশাখীর মহাতান্ডবে সিক্ত মৃত্তিকাই নবঅঙ্কুরোদগমের ভিত্তিভূমি।তমশা অবসানে যেমন নবঅরুণোদয় ঘটে, তেমনি প্রলয়ের পরেই আসে নবজীবন সৃষ্টির নতুন প্রভাত। প্রকৃতপক্ষে, কবি বোঝাতে চেয়েছেন যে, পরাধীনতাই হল মহানিশা। প্রলয়ের আগমনের মধ্য দিয়েই দেশের ভাগ্যাকাশে পরাধীনতার আঁধার কাটিয়ে স্বাধীনতার হাস্যমুখর ঊষা উদিত হবে।
‘ভেঙে আবার গড়তে জানতে সে চিরসুন্দর'—চিরসুন্দর' কে? সে কীভাবে ভেঙে আবার গড়তে জানে ?
উত্তর : উৎস : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত 'অগ্নিবীণা' কাব্যের অন্তর্গত প্রলয়োল্লাস কবিতা থেকে প্রদত্ত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
রুদ্র দেবতা হলেন সত্য-শিব-সুন্দরের প্রতীক। কবির কাছে তিনিই হলেন—'চির-সুন্দর'। — রুদ্রদেব যেমন একাধারে সংহারক, আবার অন্যধারে তিনিই সৃষ্টিকর্তা—জগৎ পিতা। প্রলয়ের প্রচণ্ডটা আসলে নবনির্মাণেরই পূর্বাভাস। প্রলয়রূপী কালবৈশাখীর মহাতান্ডবে সিক্ত মৃত্তিকাই নবঅঙ্কুরোদগমের ভিত্তিভূমি। একইভাবে, ভারতের বিপ্লবী সন্তানেরা প্রলয়ের প্রতীক হলেও অরাজকতা অচলায়তন চূর্ণ করে তারাই ভারতকে স্বাধীন করে তুলতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, চির-সুন্দরের ধ্বংস বা প্রলয়ই হল নবসৃষ্টির সোপান।
“প্রলয় বয়েও আসছে হেসে—মধুর হেসে ” – কে আসছে? তার হাসির কারণ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচিত ‘অগ্নিবীণা' কাব্যের অন্তর্গত ‘প্রলয়োল্লাস' কবিতায় মহাকালের পদধ্বনি হয়েছে। প্রলয়রূপী সেই মহাকালের আসার কথাই প্রদত্ত অংশে বর্ণিত হয়েছে।
হাসির কারণ : প্রলয়ের প্রচণ্ডতা আসলে নবনির্মাণের পূর্বাভাস। প্রকৃতপক্ষে ধ্বংসের মধ্যে লুকানো থাকে সৃষ্টির বীজ। এই কারণেই তার প্রলয়ঙ্কর রূপের মধ্যেও নতুন সৃজনের ইঙ্গিতবাহী মধুর হাসি চিরবিরাজমান।
মাভৈঃ মাভৈঃ! জগৎ জুড়ে প্রলয় এবার ঘনিয়ে আসে—প্রলয় কীভাবে ঘনিয়ে এসেছিল তা নিজের ভাষায় লেখো। অথবা আসছে নবীন-জীবনহারা অসুন্দর করতে ছেদন'—নবীন কীভাবে এসেছিল তা নিজের ভাষায় বর্ণনা করো। অথবা 'কাল-ভয়ঙ্করের বেশে এবার ওই আসে সুন্দর’–কাল ভয়ঙ্করের রূপের বর্ণনা দাও? সে কীভাবে এসেছিল? অথবা 'আসছে এবার অনাগত প্রলয় নেশায় নৃত্য-পাগল'—অনাগতের আগমনের বর্ণনা দাও। অথবা 'প্রলয়োল্লাস' কবিতার মূল ভাববস্তু আলোচনা করো।
উত্তর : উৎস : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘অগ্নিবীণা' কাব্যের অন্তর্গত ‘প্রলয়োল্লাস' কবিতা থেকে প্রদত্ত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
কবিতায় আমরা দেখতে পাই, ব্রিটিশ শাসনে পরাধীন ভারতমাতার শৃঙ্খল মোচনের প্রয়োজনে প্রলয়ের আগমন সূচিত হয়েছে।
(ক) প্রলয়ের আগমন : কালবৈশাখী ঝড়ের মতো জীর্ণতার বিনাশ করে, তান্ডবনৃত্যরত প্রলয়ের আগমন। তার রণহুংকারে সিন্ধুপারের সিংহদুয়ার পর্যন্ত ভেঙে চৌচির।
(খ) প্রলয়ের বেশ : মহাকালের চণ্ডরূপেই প্রলয়ের আগমন ঘটেছে। তার হাতে রয়েছে বজ্রশিখার জ্বলন্ত মশাল। প্রলয়দেবের উন্মত্ত কেশের ঝাপটায় আকাশ দুলছে আর তার মুখের অট্টহাসির ‘অট্টরোলের হট্টগোলে স্তব্ধ চরাচর'। এই মহাকালের অশ্ব খুরের আঘাতে আকাশ থেকে ছিটকে পড়ছে উল্কাপিণ্ড।
(গ) প্রলয়ের স্বরূপ : এই স্তব্ধতার মাঝেও প্রলয় শুরু করেছে তার ভয়াল ভ্রুকুটি। দ্বাদশ রবির অগ্নিদহন যেন তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে ঝরে পড়ছে। প্রলয়দেবের অগ্নি বর্ণের জটায় দিগন্তের কান্নার অবস্থান। এমনকি তাঁর অশ্রুবিন্দুতেও রয়েছে সুপ্ত সমুদ্রের ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাস।
মহাকালের রথের সারথি হল এই প্রলয়রূপী কালবৈশাখী। তাঁর হাতে রক্ত বিদ্যুতের চাবুক। আর এই চাবুক হাতেই প্রলয়ের সদর্প আগমন ।
'প্রলয়োল্লাস' কবিতা অবলম্বনে কবির বিদ্রোহী মানসিকতার পরিচয় দাও। অথবা ‘প্রলয়োল্লাস' কবিতা অবলম্বনে কবির স্বদেশ ভাবনার পরিচয় দাও।
উত্তর : উৎস : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত 'অগ্নিবীণা' কাব্যের অন্তর্গত প্রলয়োল্লাস কবিতা থেকে প্রদত্ত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
মন্তব্যের কারণ : সৃষ্টির উন্মেষ ধ্বংস। ধ্বংসের মধ্যে দিয়েই জীর্ণ-জরা দূরে সরে নবচেতনার জাগরণ ঘটে। প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস ‘পাতা ঝরা নয়, পাতা গড়ার মুহূর্ত'। প্রলয়ের প্রচণ্ডতা আসলে নবনির্মাণেরই পূর্বাভাস। প্রলয়রূপী কালবৈশাখীর মহাতাণ্ডবে সিক্ত মৃত্তিকাই নবঅঙ্কুরোদ্গমের ভিত্তিভূমি। কবির মতে, প্রলয় হল নতুন সৃষ্টির বেদনা মাত্র। যেহেতু ধ্বংসের মধ্যেই নিহিত থাকে সৃষ্টির বীজ, তাই তিনি ধ্বংসের প্রচণ্ডতা দেখে ভয় পেতে নিষেধ করেছেন।
'প্রলয়' শব্দের অন্দরে নিহিত আছে ধ্বংসের তান্ডব, আর উল্লাস' শব্দে আছে আনন্দের উৎসার। ধ্বংসের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা সৃষ্টির উপলব্ধি করেছিলেন কবি। তাই ভারতবর্ষের পরাধীনতা দূর করার ক্ষেত্রে তাঁর ভরসা ছিল—প্রলয়রূপী তরুণ বিপ্লবীরা। তিনি জানতেন, সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়েই ভারতবাসীরা ফিরে পাবে নিজেদের হৃত স্বাধীনতা। প্রকৃতপক্ষে প্রলয়ের ধ্বংসলীলার মাধ্যমে কবি আসন্ন প্রভাতের শতনাম গেয়েছেন। গোটা কবিতা জুড়েই আমরা তাঁর এই বিদ্রোহী মানসিকতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ লক্ষ্য করি। তাই এককথায় বলতে গেলে—কবির শব্দচয়নে, শব্দের উচ্ছ্বাসে এ কবিতা হল 'বিদ্রোহের অমৃত বাণী'।
“ওরে ওই স্তব্ধ চরাচর”—এখানে স্তব্ধ চরাচর বলতে কী বোঝানো হয়েছে? চরাচর স্তব্ধ কেন ?
উ: বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত 'প্রলয়োল্লাস' কোরাস কবিতায় স্তব্ধ চরাচর বলতে নীরব হয়ে যাওয়া এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে বুঝিয়েছেন। কবি কল্পিত ভয়ঙ্কর মৃত্যু গহণ অন্ধকূপে মহাকাল চন্ডরূপে বজ্র শিখার মশাল জ্বেলে আবির্ভূত হয়েছে দেশের অরাজকতার অবসান ঘটাতে। তার ঘন কৃষ্ণবর্ণ কেশের দোলায় আকাশ প্রকম্পিত হয়। সর্বনাশী জ্বালামুখী ধূমকেতু তার চামর দোলায়। ভয়ংকর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সে। তার সেই অট্টরোলের হট্টগোলে চরাচর স্তব্ধ হয়ে যায়।
‘প্রলয়োল্লাস' কবিতায় কবির আশাবাদ কীভাবে ফুটে উঠেছে তা আলোচনা করো। অথবা ‘ভেঙে আবার গড়তে জানে সে'- কে জানে? ‘ভেঙে আবার গড়তে জানা’–বলতে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন ?
উত্তর : উৎস : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত 'অগ্নিবীণা' কাব্যের অন্তর্গত প্রলয়োল্লাস কবিতা থেকে প্রদত্ত অংশটি গৃহীত হয়েছে।
মন্তব্যের কারণ : সৃষ্টির উন্মেষ ধ্বংস। ধ্বংসের মধ্যে দিয়েই জীর্ণ-জরা দূরে সরে নবচেতনার জাগরণ ঘটে। প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস ‘পাতা ঝরা নয়, পাতা গড়ার মুহূর্ত'। প্রলয়ের প্রচণ্ডতা আসলে নবনির্মাণেরই পূর্বাভাস। প্রলয়রূপী কালবৈশাখীর মহাতাণ্ডবে সিক্ত মৃত্তিকাই নবঅঙ্কুরোদ্গমের ভিত্তিভূমি। কবির মতে, প্রলয় হল নতুন সৃষ্টির বেদনা মাত্র। যেহেতু ধ্বংসের মধ্যেই নিহিত থাকে সৃষ্টির বীজ, তাই তিনি ধ্বংসের প্রচণ্ডতা দেখে ভয় পেতে নিষেধ করেছেন।
আশাবাদ : প্রলয় হল—‘সবুজের অভিযান'। মহাকালরূপী প্রলয়ের এই অনিবার্য আগমন যেন ‘পাতা ঝরার পাশাপাশি ‘পাতা ধরার' খেলা। প্রকৃতপক্ষে প্রলয়ের ভয়ঙ্করতা হল ‘সৃজন বেদন’। প্রলয়ময় এই মহানিশার শেষে যে নতুন ভোরের আলো প্রকাশিত হবে- ব্যাপারে কবি আশাবাদী। তিনি জানেন, প্রলয়ের শেষে রয়েছে নব সৃজনের ইঙ্গিত। তাই তো নতুন দিনের আগমনের আশায় কবি প্রলয়কে বরণ করে নিতে বলেছেন।
“ওই আসে সুন্দর”—কবি সুন্দর আসে বলতে কী বুঝিয়েছেন ?
উত্তর: রাতের অন্ধকারে ফুটফুটে সুন্দর সকাল লুকিয়ে থাকে, তেমনই কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর 'প্রলয়োল্লাস' গীতিকার একেবারে শেষাংশে ভয়ংকরের শেষে সুন্দরের আগমনের প্রত্যাশা করেছেন। শীত চলে গেলে যেমন বসন্ত দূরে থাকতে পারে না, তেমনই পরাধীন ভারতবর্ষের মহানিশার অবসানে নতুন সূর্যের রশ্মি বিকিরিত হবে। তাই কবি প্রলয়গানে মেতে উঠেছেন প্রলয়দেবতার জয়ধ্বনি করে প্রলয় চেয়েছেন, কারণ—“ওরি মাঝে আছে নববিধানের আশ্বাস দুর্ধর্ষ”। বিদ্রোহী কবি এভাবে সুন্দরের আগমন প্রত্যক্ষ করেছেন।
প্রলয়োল্লাস কবিতায় প্রলয়ের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার বর্ণনা করো। অথবা প্রলয়োল্লাস কবিতায় কবির যৌবন বন্দনার অথবা নতুন যুগের আহ্বানের রূপ নিজের ভাষায় লেখো। অথবা মহাকাল অথবা প্রলয়ঙ্কর ধ্বংস শক্তিকে কবি কিভাবে বর্ণনা করেছেন তা নিজের ভাষায় লেখো।
উ.: কবি সকলকে জয়ধ্বনি করতে আহ্বান করছেন। কালবৈশাখীর ঝড়ে তিনি নূতনের কেতন উড়তে দেখেছেন। যে প্রলয় এখন অনাগত তারই নেশায় পাগল, সেই শক্তি এসে গেছে প্রায় সিন্ধুতীরে প্রধান দ্বারে তার ধমক খেয়ে অর্গল গেছে ভেঙে সেই ভয়ংকর আসছে যেন মৃত্যুর গহন অন্ধকূথী সংহার রূপ ধারণ করে অথবা মহাকালের প্রচন্ড ধূমরূপ শক্তি হয়ে বজ্র নির্মিত সম্মান ঠেলে সে আসছে। সে ভয়ংকর অট্টহাস্য করছে। তার চামর সদৃশ কেশরাশির দোলায় মহাকাশ দুলে উঠছে। ওই অট্টহাস্য ও প্রচন্ড গর্জনে চরাচর ভীত ও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। সূর্য যেন আজ কারো হয়ে তার প্রবল রশ্মি জ্বেলেছে। তার পিন্ডাল জটায় দিগন্তের ভয়ার্ত অশ্রু যেন টলমল করছে। চোখের অশ্রুবিন্দু যেন চোখের কোলে সপ্তসিন্ধু হয়ে গর্জন করছে। বিশ্বমাতৃকা শক্তি যেন তাঁর বিশাল বাহুতে দোলায়িত। জয় প্রলয়ংকরের জয়। এবার যেন সমস্তই বিনাশের ঘূর্ণিপাকে সমাপ্ত হবে মহাঘোর নিশার অবসানে এবার আসবে তরুণ ও নবীন ঊষা, দিগম্বর যেন ঘটায় ধরবেন শিশু চন্দ্রকে, এবার সকল শূন্যতা পাবে পূর্ণতা। ওই যে মহাকালের রথের চালক রক্তশোভিত চাবুক বিদ্যুৎ সহযোগে তুলে ধরছেন। শোনা যাচ্ছে অশ্বের হ্রেষাধ্বনি ঝড়, তুফান ও বজ্র মধ্যে নীল আকাশে' অঙ্গ ফুঁড়ে যেন উল্কা ছিটকে পড়ছে। অন্ধকারে বন্ধ ঘরে দেবতা বাঁধা পড়ে আছেন। ওই যে শোনা যায় রথঘর্মর। ধ্বংস দেখে ভয় পাবার কারণ নেই। প্রলয় যেমন ধ্বংস করে সেই তো আবার সৃষ্টি করবে। জীবনহীন প্রাণহীন সুশ্রীতাকে শেষ করতে সে আসছে। ভেঙে গড়তে পারে ওই মহাকাল। সে তো চিরসুন্দর তাই তাকে ভয় না করাই ভালো। বধূরা যেন বরণ প্রদীপ জ্বেলে তাঁকে আহ্বান করে। কাল ভয়ংকরের বেশে আসছে যে চিরসুন্দর জয়ধ্বনি সকলে যেন জয়ধ্বনি করে।