জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বোঝায় ? জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিভিন্ন উপায় বা উপাদনগুলি আলোচনা করো ।

উত্তর :- আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশারদগণ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় স্বার্থের ধারণা দিয়েছেন । আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম একটি মৌলিক ধারণা হল জাতীয় স্বার্থ । জাতীয় স্বার্থ বলতে যাবতীয় মূল্যবোধের সমষ্টিকে বোঝায় । এক কথায় জাতীয় স্বার্থ বলতে জাতীয় নিরাপত্তা , জাতীয় উন্নয়ন , শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ইত্যাদি নূন্যতম রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে বোঝায় , যেগুলি পূরণের জন্য প্রতেকটি রাষ্ট্র সক্রিয় উদ্যোগ নেয় । অধ্যাপক হার্টম্যানের মতে জাতীয় স্বার্থ হল বিভিন্ন ধরনের আকাঙ্ক্ষা যা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করতে চায় । বাস্তববাদী তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা মরগেনথাউ - এর মতে যে - কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ । 

জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিভিন্ন উপায়সমূহ : প্রত্যেকটি দেশের জাতীয় ব্যবস্থাপনা নির্দিষ্ট কর্মসূচি , মতাদর্শ ও মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয় । এই মূল্যবোধ ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি বা উপায়গুলি নিম্নরূপ

 (a) কূটনীতি:-   জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের একটি বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি বা উপায় হল কূটনীতি । কূটনৈতিক পর্যায়ের উদ্যোগ ও আয়োজন বহু কঠিন সমস্যার সমাধানরূপে কাজ করে । সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে নীতিবিদরা তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করে— ( i ) আস্থা অর্জন , ( ii ) আপস মীমাংসা ও ( iii ) বলপ্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন । কূটনীতির প্রয়োগের মধ্য দিয়েই কোনো দেশ তার জাতীয় শক্তির অন্যান্য উপাদানগুলিকে স্বার্থকভাবে বাস্তবায়িত করে থাকে । এই কারণেই কূটনীতিবিদদের পামার ও পারকিনস সরকারের চক্ষু ও কর্ণ ’ বলে চিহ্নিত করেছেন । 

 ( b ) প্রচারকার্য সম্পাদন:-  প্রচারকার্য জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের আর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম । কোনো দেশ তার পররাষ্ট্র নাতির সমর্থনে সমগ্র বিশ্বদরবারে প্রচারকার্য চালায় , যাতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ওই প্রচারের সমর্থনে ব্যাপক সাড়া পড়ে । এই প্রচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে থাকে , যেমন ঠাঁন্ডা লড়াইয়ের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্ব দরবারে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করে বিশ্ব জনমত গঠনের জন্য রেডিও , টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটিয়েছিল ।

 ( c ) জোটবন্ধতা  :- জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশগুলির মধ্যে জোট গঠনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় । মূলত জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ , শক্তিবৃদ্ধি , প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিজোটের মোকাবিলা এই উদ্দেশ্যেই জোট গঠনের প্রবণতা দেখা যায় । যেমন , সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক এবং মার্কিন পুঁজিবাদী এই দুই পরস্পর বিরোধী মতাদর্শকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াইয়ের উদ্ভব ঘটলেও পরবর্তী সময়ে মার্কিন নেতৃত্বে NATO জোট ও সোভিয়েত নেতৃত্বে WARSAW জোটের উদ্ভব ঘটে । আবার উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ প্রশমনকারী নিরপেক্ষ জোট হিসেবে NAM- এর উপস্থিতিও চোখে দেখার মতো । 

জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বোঝায় ? জাতীয় স্বার্থ রক্ষার বিভিন্ন উপায় বা উপাদনগুলি আলোচনা করো ।

( d ) অর্থনৈতিক সাহায্য ও ঋণ প্রদান : আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও প্রভাব । বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় উন্নত দেশগুলি , দরিদ্র ও বিকাশশীল দেশগুলোর কাছে অর্থনৈতিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় । এই রূপ সহযোগিতা বা ঋণ প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য হল ঋণ গ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলির অকুন্ঠ সমর্থন আদায় করা । যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকারাগুয়া , অ্যাঙ্গোলা , আফগানিস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করা যায় ।

 ( e ) বল প্রয়োগ : জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে উন্নত ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি অনেক সময় অপর রাষ্ট্রগুলির ওপর বলপ্রয়োগ বা বলপ্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন করে থাকে । সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে ইরাকের উপর মার্কিন আগ্রাসনের কথা বলা যায় । প্রাক্তন ইরাকের রাষ্ট্রপতি সাদ্দাম হুসেনের ফাঁসি অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত ।

 ■ পরিশেষে বলা যায় , জাতীয় স্বার্থকে অবহেলিত করে কোনো দেশই তার পররাষ্ট্র বা বিদেশনীতি প্রয়োগ করতে পারে না । প্রতিটি দেশের ক্ষমতা বা শক্তির উপাদানগুলি ভিন্ন আর এই ভিন্নতার উপর নির্ভর করে জাতীয় স্বার্থের চাহিদা নির্ধারিত হয় । তবে বিদেশনীতির মৌলিক উপাদন হিসেবে জাতীয় স্বার্থের বিকল্প নেই । 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
×