হারিয়ে যাওয়া কালি কলম প্রবন্ধে সমস্ত বড়ো প্রশ্ন ও উত্তর।

 'আশ্চর্য, সবই আজ অবলুপ্তির পথে।' -কি আছে অবলুপ্তির পথে? বক্তার আশ্চর্য লেগে গেছে কেন? অবলুপ্তির পথে চলে যাওয়ার কারন কি?

অতীতে কত রকমের কলম ছিল । সময়ের সঙ্গে কলমের দুনিয়ায় পরিবর্তন এসেছে । উন্নত থেকে উন্নততর কলমের আবির্ভাব ঘটেছে । আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো প্রযুক্তির -কলম অবলুপ্ত হয়ে গেছে । একসময়ে ছিল কঞ্চির , খাগের , পালকের কলম । তারপর এল ফাউন্টেন পেন । তারও পরে বল পেন । দোয়াত - কালির প্রয়োজনও ফুরোয় আস্তে আস্তে । আজকের উন্নত প্রযুক্তির হাত ধরে এসেছে কম্পিউটার । ফলে বলপেনও যেন অবলুপ্ত হতে চলেছে ।

 লেখকের আশ্চর্য লেগেছে , কারণ কলম ছাড়া লেখালেখির কথা কিছুকাল আগেও মানুষ , ভাবতে পারেনি । কলম ছাড়া কোনো লেখকের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যেত না । কিন্তু আজ কম্পিউটার এসে কালি কলমকে ' জাদুঘর পাঠাবে বলে যেন প্রতিজ্ঞা করেছে ।

ফাউন্টেন পেন বাংলায় কি নামে পরিচিত? নামটি কার দেয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে? ফাউন্টেন পেনের জন্ম ইতিহাস লেখ?

ফাউন্টেন পেনের বাংলা নাম ঝরনা কলম । 

নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেওয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।

 ফাউন্টেন পেনের জন্ম - ইতিহাসটি বেশ চমকপ্রদ । এর আবিষ্কারক লুইস অ্যাডসন ওয়াটারম্যান । সেকালের আরও অনেক ব্যবসায়ীর মতো তিনিও দোয়াত কলম নিয়ে কাজে বের হতেন। একবার তিনি গিয়েছেন আর একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তিপত্র সই করতে । দলিল কিছুটা লেখা হয়েছে এমন সময় দোয়াত হঠাৎ উপুড় হয়ে পড়ে গেল কাগজে । আবার তিনি  ছুটলেন কালির সন্ধানে । ফিরে এসে শোনেন , ইতিমধ্যে আর একজন তৎপর ব্যবসায়ী সইসাবুদ  করে চুক্তিপত্র পাকা করে গেছেন । তখন বিমর্ষ ওয়াটারম্যান মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন , এর একটা বিহিত করতেই হবে । তারপরই আবিষ্কার করলেন ফাউন্টেন পেন ।

হারিয়ে যাওয়া কালি কলম

সব মিলিয়ে লেখালেখি রীতিমতো ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠান বক্তা এ কথা বলেছেন কেন ? অনুষ্ঠানটির পরিচয় দাও ।  

লেখালেখির উপকরণগুলি একসময় আজকের মতো সহজলভ্য ছিল না । লেখার জন্য অনেক আয়োজনের প্রয়োজন হত । তাই বক্তা শ্রীপান্থ প্রশ্নে উদ্ধৃত কথাটি বলেছেন 

লেখকদের ছোটোবেলায় ছিল কঞ্ঝির ও খাগের কলম । গ্রামে থাকার সময় লেখক ও তার সমবয়সিরা কঞ্চি কেটে কলম বানাতেন । কলমের মুখ ছুঁচালো করে মাঝখানে চিরে দিতে হত যাতে কালি ধীরে চুঁইয়ে পড়ে । রান্নার কড়াইয়ের নীচে যে কালি জমত তা লাউপাতা দিয়ে ঘষে তুলে পাথরের বাটিতে জলে গোলা হত । তাতে ভাজা আতপ চালের গুঁড়ো মিশিয়ে হরীতকী ঘষে , খুন্তি পোড়া ডুবিয়ে ছেঁকে নিলে তৈরি হত লেখার কালি । দোয়াতের কালিতে কঞ্চির কলম ডুবিয়ে কলাপাতায় লেখা হত ।।

শহরে এসে হাইস্কুলে পড়ার সময় লেখক অপেক্ষাকৃত উন্নত , আধুনিক কলমে লিখতেন । ক্যালিট্যাবলেট বা কালিবাড়ি গুলে কালি বানাতেন । লাল ও নীল দুরকমের কালিবাড়ি পাওয়া যেত । দোয়াতে ও বোতলে করে কালিও কিনতে পাওয়া যেত । একসময়ে কালি শুকনো হত বালি দিয়ে । পরে এল ব্লটিং পেপার । ফাউন্টেন পেন পেন আসার পর বিপ্লব ঘটল কলমের দুনিয়ায় । কঞ্ঝির , খাগের পালকের কলম , দোয়াত ইত্যাদি পুরোনো উপকরণগুলো ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে গেল । কিন্তু ফাউন্টেন পেন প্রচলিত হওয়ার আগে পর্যন্ত লেখালেখি ছিল রীতিমতো ছোটোখাটো একটা অনুষ্ঠান ।

“ কিন্তু সে ছবি কতখানি যন্ত্রের , আর কতখানি শিল্পীর ? ” ' —'সে ছবি ' বলতে লেখক কোন ছবির কথা বলেছেন ? যন্ত্রের ছবি আর শিল্পীর ছবির মধ্যে পার্থক্য কী ? ১ + ৪

 সে ছবি ’ বলতে লেখক কম্পিউটারে আঁকা ছবির কথাই বলেছেন । 

কম্পিউটার নামের যন্ত্রে কারিগরি সহায়তায় ছবি আঁকা হয় । সেই ছবির সঙ্গে মনের কোনো সংযোগ নেই । ছবি আঁকাও উন্নত শিল্পকর্ম । শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্ক অভেদ্য । কম্পিউটারের মন বলে কিছু নেই । তার রেখা নিছকই যন্ত্রের আঁকিবুকি । আর শিল্পী ছবি আঁকেন অনুভূতির রং ও রেখায় । সেখানে মনের মাধুরী মিশে থাকে । থাকে শিল্পীর আবেগ এবং মনের গভীরে সযত্নলালিত চিন্তা । রবীন্দ্রনাথও অক্ষর কাটাকাটি করতে গিয়ে আনমনে এঁকে ফেলতেন সাদা - কালো ছবি । এই ছবির মধ্যে আছে খেয়ালি আবেগের প্রকাশ । কিন্তু কম্পিউটারে সেই আবেগ - অনুভূতির কোনো বালাই নেই । লেখক বলতে চেয়েছেন , মনের জিনিসকে যন্ত্রের সাহায্যে রূপ দিতে গেলে তা কৃত্রিম হয়ে পড়ে । আবেগ ছাড়া শিল্প কখনও জীবন্ত হয় না । ভাব ঘনীভূত হলে মনের ক্যানভাসে অমূর্ত ছবি দানা বাঁধে । শিল্পী তাকে রং - তুলির সাহায্যে মূর্ত করে তোলেন । তাই কম্পিউটারের ছবির চেয়ে শিল্পীর আঁকা ছবি বেশি প্রাণময় এবং শিল্পিত।

আমরাও ফালি তৈরি করতাম নিজেরাই ।--- কালি তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে যা জান লেখো । 

হারিয়ে যাওয়া কালি কলম ' প্রবন্ধে তাদের ছোটবেলায় বাঁশের কঞ্চির কলম যে কালিতে ডুবিয়ে লিখতেন সেই কালি নিজেরা কীভাবে তৈরি করতেন তা বলেছেন । 

এই কালি তৈরির কাজে লেখকরা বাড়ির অন্যদের সাহায্য নিতেন । এই কাজে যে উপকরণগুলি লাগত সেগুলি সংগ্রহ করা একটু কঠিন হত কখনো কখনো । এই কালি তৈরির পদ্ধতিতে তিল , ত্রিফলা অর্থাৎ হরীতকী , বহেড়া , আমলকী লোহার পাত্রে ছাগলের দুধে ভিজিয়ে রাখতে হয় । এরপর একটি লোহার দণ্ড দিয়ে সেটি ভালো করে ঘষে নিতে হত । এই কালি এতটাই টেকসই হত যে কাগজ ছিঁড়লেও কালি উঠত না । এটি ছিল কালি তৈরির একটি প্রাচীন পদ্ধতি ।

 লেখকরা দ্বিতীয় যে পদ্ধতিতে কালি তৈরি করতেন সেই ঘরোয়া পদ্ধতিটি ছিল অনেক সহজ । বাড়ির কাঠের উনুনে যে কড়াইয়ে রাখা হত তার তলায় কালি জমত । সেই কালি লাউপাতা নিয়ে ঘধে তুলে নিয়ে পাথরের বাটিতে রাখা জলে গুলে নেওয়া হত । কেউ কেউ এর মধ্যে হরীতকী ঘষতেন এবং পোড়া আতপচালের গুঁড়ো মিশিয়ে দিতেন । এরপর খুস্তি লাল করে পুড়িয়ে সেই জলে ডোবালে জল ফুটত । জল ঠান্ডা হলে ন্যাকড়া ছেঁকে দোয়াতে ভরে নিতে হত। এইভাবে প্রস্তুত করা হতো ঘরের তৈরি কালি।


“ কলম তাদের কাছে আজ অস্পৃশ্য । " - কলম কাদের কাছে অস্পৃশ্য ? কলম সম্পর্কে লেখক কেন এরূপ বলেছেন?

' হারিয়ে যাওয়া কালি কলম ' রচনায় সময়ের অগ্রগতিতে কলমের পরিণতি দেখে লেখক নিখিল সরকার এই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যটি করেছেন।

আধুনিকতার পথে কলম ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে মানুষের হাত থেকে । সময়ের ধারায় বাঁশের পেন , পালকের পেন ক্রমশ হারিয়ে গিয়ে ফাউন্টেন পেন , সস্তার বল পেন বাজারে আসে । তাই পকেটমারও কলম চুরি করে না — ' কলম তাদের কাছে আজ অস্পৃশ্য । 

একসময়ে মানুষের লেখার একমাত্র অবলম্বন ছিল বাঁশের কলম । শৈশবে লেখকরা এরূপ কলম নিজেরাই বানাতেন । সময়ের অগ্রগতিতে বাঁশের কলম উধাও হয়ে এল পালকের কলম । তারপর ফাউন্টেন পেন এবং বল পেন বাজার দখল করল । ব্রুমশ ফেরিওয়ালারাও কলম বিক্রিকে পেশা করল । লেখক অতি - আধুনিক ছেলেদের বুকপকেটের পরিবর্তে কাঁধের ছোটো পকেটে কলম সাজিয়ে রাখতে দেখেছেন । এমনকি ভিড় ট্রামে - বাসে মহিলাদের মাথার খোঁপাতেও কলম গোঁজা রয়েছে — এমনও দেখা গিয়েছে । লেখকের ভাষায় — ‘ বিস্ফোরণ । কলম বিস্ফোরণ । ' কলম একসময় সুলভ ও সর্বভোগ্য হয়ে উঠল । এভাবেই কলম একসময় তার কদর হারিয়ে ফেলে । ফলে যে পকেটমার একসময় কলম হাতসাফাই করত তার কাছেও কলম অস্পৃশ্য হয়ে গেল ।

কলমকে বলা হয়েছে তলোয়ারের চেয়েও শক্তিধর — বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ।  একথা বলার কারণ ব্যাখ্যা করো ?

 শ্রীপান্থের লেখা ' হারিয়ে যাওয়া কালি কলম ' প্রবন্ধে উল্লিখিত বাক্যটি একটি প্রবাদ এ পরিণত হয়েছে । বাস্তবে তলোয়ারের চেয়ে বন্দুকের শক্তি বেশি । আর ফাউন্টেন পেনের বি অংশের নাম ' ব্যারেল ' , ' কার্টিজ ’ ইত্যাদির সঙ্গে বন্দুকের সম্পর্ক আছে । তবে বন্দুকের সঙ্গে কলমের সম্পর্ক নেই । এই সম্পর্ক প্রতীকী । প্রতীকী অর্থেই কলম তলোয়ারের চেয়ে বেশি শক্তিধর । তলোয়ার শারীরিকভাবে মানুষকে আঘাত করতে পারে , হত্যাও করতে পারে । কিছু কলম তা পারে না । অথচ উৎকৃষ্ট লেখার মাধ্যমে অর্থাৎ কলমের একটুখানি আঁচড়ে কাউকে মানসিকভাবে যে আঘাত করা যায় বা মনের জড়তাকে নাড়িয়ে দিয়ে উন্নত চিন্তনের অধিকার করে তোলা যায় , সুস্থ চিন্তার জগতে ফিরিয়ে আনা যায় তা তলোয়ারের দ্বারা কখনোই সম্ভব হয় না । ইতিহাসে দেখা যায় , বিপ্লব যখন আসে তখন শারীরিক শক্তির সঙ্গে বৌদ্ধিক শক্তি একইরকম ব্যবহার করা হয় । আর একাজে কলমের আঁচড় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে । প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে কলম হয়ে ওঠে অন্যতম হাতিয়ার । কলমের এক খোঁচায় জনগ জাগ্রত হয়ে ওঠে । 

মানুষের লিখন - দক্ষতা অস্ত্রের থেকেও মারাত্মক । লেখার প্রভাব সুদূরপ্রসারী । শুধু সমকাল নয় , ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও কলমের সৃষ্টি আলোড়িত করে । চিন্তা , ভাবনা , কল্পনার সহস্র দিক খুলে দেয় । মানুষের তথা দেশ - কাল - জাতি - ধর্ম নির্বিশেষে বিশেষ একটি লেখার প্রভাব থেকে যায় । তাই বলা যায় , কলমই সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র । তবে লেখক কিছুটা চিন্তিত , কারণ কম্পিউটারে আগ্রাসনে এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে । 

“ আমার মনে পড়ে প্রথম ফাউন্টেন কেনার কথা ।'- লেখক কোথায় ফাউন্টেন কিনতে গিয়েছিলেন ? তাঁর কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল ? ১ + ৪ = ৫ 

 ‘ হারিয়ে যাওয়া কালি কলম ' রচনায় লেখক জানিয়েছেন কলকাতার কলেজস্ট্রিটের একটি নামি দোকানে তিনি ফাউন্টেন পেন কিনতে গিয়েছিলেন । 

ফাউন্টেন পেন আবিষ্কার পেনের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে এক অফুরন্ত কালির ফোয়ারা খুলে দিয়েছিল । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকবছর পরে কোনো একদিন লেখক কলেজস্ট্রিটের একটি নামি দোকানে ফাউন্টেন পেন কিনতে গিয়েছিলেন । দোকানদার তাঁকে পার্কার , শেফার্ড , ওয়াটারম্যান , সোয়ান , পাইলট হরেক রকম পেনের নাম ও তাদের দামের কথাও বলেন । লেখকের মুখের অবস্থা দেখে আর তাঁর পকেটের অবস্থা বুঝতে পেরে দোকানদার তাঁকে একটা সস্তা জাপানি পাইলট কলম কিনতে বলেন । দোকানদার পেনটির ঢাকনা খুলে একটি কাঠের বোর্ডের ওপর বাংলা ছুঁড়ে দেন । সার্কাসে যেমন জীবন্ত মানুষের দিকে ছুরি ছুঁড়ে দেওয়ার পরও সে অক্ষত থাকে , বোর্ড থেকে খুলে দোকানদারও দেখান , পেনটার নিব অক্ষত আছে । তারপর তিনি দু - এক ছত্র লিখেও দেখান । আনুমানিক পনেরো - ষোলো বছরের কিশোর লেখকের কাছে পেনটি জাদুপেন বলেই মনে হয় । লেখক পরবর্তীকালে অনেক ফাউন্টেন পেন কিনলেও বহুদিন ওই জাপানি পাইলটটি তিনি যত্ন করে রেখেছিলেন । এই প্রসঙ্গেই লেখক জানিয়েছেন যে ফাউন্টেন পেন সংগ্রহের নেশা অনেক লেখকের মধ্যেই তিনি দেখেছেন । 




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
×