সমাজ ও শিক্ষার সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদানের মূল্যায়ন করো।

 সূচনা

ঊনবিংশ শতকে রাজা রামমোহন রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সমাজের অধোগতি দূর করে যে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তা ভারতে নবজাগরণের সূচনা করে। শ্রীমতী সোফিয়া কোলে এপ্রসঙ্গে বলেছেন-"His role was that of an enlightener." রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে 'ভারতপথিক' বলে অভিহিত করেছেন। অধ্যাপক রাখালচন্দ্র নাথ মনে করেন, "ইন্ডিয়ান রিফর্মেশনে তাঁর কীর্তি অবিনশ্বর।"

সমাজ সংস্কার:

 সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের প্রগতিশীল কর্মসূচি এইরকম-

সতীদাহপ্রথা বিরোধী: রামমোহন রায় অমানবিক সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে প্রচার করে এক শক্তিশালী জনমতের সমন্বয়ে 1829 খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর দ্বারা সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্য আইন পাশ করেন।

কুসংস্কার দূরীকরণ: রামমোহন রায় ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম সামাজিক অজ্ঞতা, কুসংস্কার দূর করার কাজে অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি কৌলীন্যপ্রথা ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করেছিলেন।

জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা: রামমোহন রায় সম্পূর্ণ যুক্তির দ্বারা জাতিভেদপ্রথা ও বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে এক শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলেন যা ভারতীয় সমাজ সংস্কারের পথ প্রশস্ত করেছিল।

শিক্ষার সংস্কার: 

ধর্ম তথা সামাজিক সংস্কার ছাড়াও পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারে তথা আধুনিক শিক্ষাপ্রসারে রামমোহন রায়ের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। তাঁর উদ্যোগে শিক্ষার সংস্কার হয়েছিল এইভাবে-

 শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন: স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফকে রামমোহন রায় জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন' গড়ে তোলায় সাহায্য করেন। 1822 সালে তিনি কলকাতায় 'অ্যাংলো হিন্দু স্কুল' গড়ে তোলেন। এছাড়াও 1817 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপনে তিনি সহায়তা করেন।

সংবাদপত্র প্রকাশনা: রামমোহন রায় বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি ভাষায় বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল 'সম্বাদ কৌমুদী' এবং ফার্সিতে প্রকাশিত-'মিরাৎ-উল-আকবার'।

 পাশ্চাত্য শিক্ষাকে সমর্থন রামমোহন রায় দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারকে সমর্থন করতেন। তৎকালীন গভর্নর লর্ড আমহার্স্টকে একটি চিঠিতে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রসারের অনুরোধ জানান রামমোহন রায়।

 বাংলা গদ্যের জনক: রামমোহন রায়কে বলা হয় 'বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক'। তিনি 1815-23-এর মধ্যে প্রায় 23টি গ্রন্থ রচনা করেন।

ধর্মীয় সংস্কার:

 ধর্মীয় সংস্কারের ক্ষেত্রেও রামমোহন রায়ের অনবদ্য অবদান লক্ষ করা যায়-

 একেশ্বরবাদী ধর্মের পুনরুজ্জীবন রামমোহন ধর্মীয় কুসংস্কার ও মূর্তিপূজার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি বেদান্তের ওপর ভিত্তি করে একেশ্বরবাদী ধর্মের পুনরুজ্জীবন সাধন করতে চেয়েছিলেন। • আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা: তৎকালীন সমাজে মূর্তিপূজার অসারতা, জাতিভেদপ্রথা ও সতীদাহ প্রথা সম্বন্ধে আলোচনার জন্য 1815 খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় তিনি 'আত্মীয় সভা'গঠন করেন।

 ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা: পৌত্তলিকতার অবসান করে নিরাকার পরম ব্রহ্মের উপাসনার জন্য তিনি উপনিষেদকে ভিত্তি করে 1828 খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ নামে একটি একেশ্বরবাদী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

মন্তব্য:

 পরিশেষে বলা যায়, রাজা রামমোহন রায় এসেছিলেন এক যুগ সন্ধিক্ষণে। তাঁর সংস্কার ও কর্মসূচির দিকে লক্ষ রেখে ঐতিহাসিক পার্শিভ্যাল স্পিয়ার বলেছেন-"রামমোহন রায় ছিলেন আধুনিক ভারতের স্রষ্টা।"

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url
×