ক্ষমতা কাকে বলে ? ক্ষমতার উপাদানগুলো আলোচনা করো অথবা ,, জাতীয় শক্তি কাকে বলে ? জাতীয় শক্তির উপাদানগুলি আলোচনা ।
উত্তর :- ক্ষমতা বা শক্তির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ' Power ' । যার অর্থ হল সক্ষমতা । জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেলের মতে অন্যের মন ও কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে কাঙ্খিত ফললাভের সামর্থ্যই হল ক্ষমতা বা শক্তি । আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় জাতীয় শক্তি বা ক্ষমতার ধারণা গুরুত্বপূর্ণ । মরগেন থাউ - এর মতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ক্ষমতার লড়াই । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো একটি রাষ্ট্র কী অবস্থান নেবে তা নির্ভর করে ক্ষমতার উপর । যেমন — বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে । ক্ষমতা বা শক্তির উপাদানগুলি নিম্নরূপ
( a ) ভৌগোলিক উপাদানঃ মরগেনথাউ - এর মতে ভৌগোলিক উপাদনটি হল কোনো একটি দেশের জাতীয় শক্তির স্থায়ী উপাদান । জাতীয় শক্তির নির্ধারক হিসেবে ভৌগোলিক উপাদানটিকে চারটি দিক থেকে আলোচনা করা যায়—
( i ) অবস্থান : কোনো একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান সামরিক ও বৈদেশিক শত্রুর হাত থেকে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে । যেমন — বলা যায় , পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান এমনভাবে সমুদ্রবেষ্টিত যে ইউরোপ ও এশিয়ার কোনো স্থল শক্তির পক্ষে তাকে আক্রমণ করা সহজ নয় । তবে বর্তমান আণবিক যুগে এরূপ ভৌগোলিক অবস্থানও যে নিরাপদ সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে ।
( ii ) আয়তন : ভৌগোলিক সীমারেখাগত দিক থেকে কোনো একটি রাষ্ট্রের আয়তন সেই দেশের জাতীয় শক্তি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । তবে আয়তনগত দিক থেকে বৃহৎ হলেই হল না , দেশটি পরিচালনার জন্য সুদক্ষ নেতৃত্বও প্রয়োজন । যেমন , চিনের বৃহৎ আয়তন চিনকে একটি বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে ।
( iii ) জলবায়ু : জলবায়ু একদিকে দেশের অর্থনীতিকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করে তেমন মানুষের কর্মক্ষমতাও নির্ধারণ করে । যেমন , মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত দেশগুলি কৃষিকাজের উন্নতির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটিয়েছে । আবার নাতিশীতোয় অঞ্চলের জলবায়ুকে অর্থনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতির আদর্শ জলবায়ু বলা হয় ।
( iv ) ভূপ্রকৃতিঃ ভূপ্রকৃতি বলতে কোনো দেশের অন্তর্গত পাহাড় , পর্বত , নদী , মালভূমি , সমভূমি ইত্যাদি সবকিছুকেই বোঝায় । আবার নদনদী যেমন অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সুনিশ্চিত করে , তেমনই পাহাড় , পর্বত , মালভূমি ইত্যাদি ভূমিরূপের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে ।
( b ) জনসংখ্যা : কোনো দেশের জনসংখ্যা বা মানবসম্পদ হল জাতীয় শক্তির অন্যতম একটি উপাদান । প্রতিরক্ষা , দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ব্যাপকতা প্রয়োজন । তবে প্রয়োজনের তুলনায় দেশের অধিক জনসংখ্যা দারিদ্র্য , অপুষ্টি , বেকারত্ব , সৃষ্টি করে । ফলে তা জাতীয় শক্তির অবনমন সূচিত করে ।
( c ) প্রাকৃতিক সম্পদ : প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের স্থায়ী ক্ষমতার উদাহরণ । প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে বোঝায় কৃষিজ সম্পদ , খনিজ সম্পদ , বনজ সম্পদ , জলজ ও প্রাণীজ সম্পদ ইত্যাদি । যে দেশ যত বেশি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ সেই দেশ তত বেশি স্বনির্ভর । যেমন , বলা যায় মধ্যপ্রাচ্যের খনিজতেল উৎপাদনকারী দেশগুলির আয়ের বেশিরভাগ অংশটাই আসে খনিজ তেল থেকে ।
( d ) সামরিক ব্যবস্থাপনাঃ কোনো দেশের সামরিক শক্তি জাতীয় শক্তির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । সামরিক ব্যবস্থা শক্তিশালী না থাকলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে । পড়তে হয় । আধুনিক অস্ত্র সমৃদ্ধ শক্তিশালী স্থলবাহিনী , নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রাধান্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায় । তবে এক্ষেত্রে উন্নতমানের প্রযুক্তিবিদ্যা , সুযোগ্য নেতৃত্ব , সেনাবাহিনীর গুণগতমান প্রত্যাশিত হওয়া দরকার ।
( e ) রাজনৈতিক উপাদানঃ দেশের শক্তি অনেকাংশে নির্ভর করে সরকারের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার উপর । দক্ষ , বিচক্ষণ ও সুযোগ্য নেতৃত্বই দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে পারে । তবে উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমলা বা উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারীদের সততা , দক্ষতা ও জনকল্যাণকর কর্মসূচির মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে ।
( 1 ) কূটনীতি:- মরগেনথাউ কূটনীতিকে জাতীয় শক্তির মস্তিষ্করূপে বর্ণনা করেছেন । কূটনীতিকে সমস্যা সমাধানের শেষ অস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । কূটনীতির মধ্য দিয়েই জাতীয় শক্তির অন্যান্য উপাদানগুলোেক সার্থকভাবে প্রয়োগ করা যায় । বৈদেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা , অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য কূটনীতিবিদদের ভূমিকা অপরিসীম । পামার ও পারকিনস কূটনীতিবিদদের নিজ নিজ দেশের চক্ষু ও কর্ণ ' বলে চিহ্নিত করেছেন ।
পরিশেষে বলা যায় , কোনো একটি দেশের জাতীয় শক্তির সব উপাদানগুলি সমান মাত্রায় বিরাজ করে না । তা ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার উপাদানগুলি সতত পরিবর্তনশীল । জাতীয় ক্ষমতা নির্ভর করে সরকারের ক্ষমতার উপাদনগুলিকে কতটা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছে তার উপর ।