ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা , কার্যাবলি ও পদমর্যাদা আলোচনা করো । ( উ.মা. 13 , 18 , 20)
উত্তর :- কেন্দ্রীয় সংসদীয় শাসনব্যবস্থার মতো ভারতে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যগুলিতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে । সংসদীয় শাসনব্যবস্থার রীতি অনুসারে দুই প্রকার শাসকের উপস্থিতি থাকে — প্রকৃত শাসক ও নামে মাত্র শাসক । সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির প্রকৃত শাসক হলেন মুখ্যমন্ত্রী এবং নামেমাত্র শাসক হলেন রাজ্যপাল ।
কোনো অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে গেলে প্রার্থীকে অবশ্যই ভারতীয় নাগরিক হতে হবে এবং তাকে অঙ্গরাজ্যের আইনসভার সদস্য হতে হবে । তবে আইনসভার সদস্য না হয়েও তিনি 6 মাস মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকতে পারেন । সংবিধানের 164 নং ধারা অনুসারে তত্ত্বগতভাবে রাজ্যের শাসন বিভাগের কার্যনির্বাহী প্রধান হিসেবে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়োগ করেন । তবে বাস্তবে বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতা বা নেত্রীকে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেন । আবার কোনো দলের বা জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত না হলে মুখ্যমন্ত্রী নিয়োগের বিষয়ে রাজ্যপাল তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন । মুখ্যমন্ত্রীর কার্যকালের মেয়াদ 5 বছর । তবে তার পূর্বে বিধানসভা ভেঙে গেলে তাকে পদচ্যুত হতে হয় ।
● মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি : সংবিধানে বিস্তারিতভাবে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলোচিত হয়নি । তবে রাজ্যের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার কিছুটা অনুরূপ । ভারতের কোনো অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী নিম্নরূপ--
( a ) রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ : রাজ্য সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম , নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে রাজ্যপালকে অবগত করেন মুখ্যমন্ত্রী । তিনিই রাজ্যপালকে রাজ্যের মন্ত্রীদের অপসারণ , পদবণ্টন ও পদের পুনাবণ্টন সম্পর্কে যাবতীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন । তা ছাড়া রাজ্য আইনসভার অধিবেশন আহ্বান , স্থগিত রাখা বা ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন । এইভাবে রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংযোগসাধনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন মুখ্যমন্ত্রী ।
( b ) রাজ্য আইনসভার নেতা হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী :- ভারতের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট রাজ্য আইনসভার নিম্নকক্ষ বিধানসভা এবং এককক্ষবিশিষ্ট রাজ্য আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হলেন মুখ্যমন্ত্রী । রাজ্য আইনসভার নেতা হিসেবে তিনি ( i ) মন্ত্রীসভা গঠন করেন , ( ii ) রাজ্য আইনসভার কার্যক্রম স্থির করেন , ( iii ) রাজ্য আইনসভার অধিবেশন কখন ডাকা হবে , কখন স্থগিত রাখা হবে , কোন বিষয়ের উপর আলোচনা চলবে , এমনকি বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে তিনি রাজ্যপালকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন , ( iv ) কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিলের উপর বক্তৃতা বা সরকারি দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা তাঁর অন্যতম কর্তব্য , ( v ) বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে কেবল বিরোধিতাই নয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা । তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ।
( c ) রাজ্য মন্ত্রীসভার নেতা : সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রাজ্যের শাসনবিভাগের যে ক্ষুদ্র অংশটি মুখ্যমন্ত্রীকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও আস্থাভাজন মন্ত্রীদের নিয়ে । গঠিত হয় তাকে ক্যাবিনেট বলে । মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য ক্যাবিনেটের সভায় সভাপতিত্ব করেন । তিনি নক্ষত্রদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র । রাজ্য ক্যাবিনেটের কোনো সিদ্ধান্ত তাকে বাদ দিয়ে হতে পারে না । মুখ্যমন্ত্রীর বিরাগভাজন কোনো মন্ত্রীই রাজ্য ক্যাবিনেটে স্থায়ী থাকতে পারে না । মন্ত্রীসভার কাজকর্ম পরিচালনার জন্য যে সচিবালয় থাকে তা মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীনে কাজ করে ।
( d ) রাজনৈতিক দলের নেতাঃ বিধানসভা নির্বাচনের পর আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতা বা নেত্রীকেই মুখ্যমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করতে হয় রাজ্যপালকে । তাই উক্ত দল বা জোটের ভাবমূর্তির দিকে সর্বদা দৃষ্টি রাখতে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে । নিজের দলের প্রসারণ , অখণ্ডতা ও ঐক্য যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে এবং পরবর্তী নির্বাচনে তার দলের সাফল্য যাতে বজায় থাকে সেদিকে সদা সতর্ক থাকতে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে । এই কারণে দলের প্রতি জনসমর্থন আদায়ের জন্য প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমকে তিনি ব্যবহার করে থাকেন ।
( e ) রাজ্য জনগণের নেতা :- মুখ্যমন্ত্রী হলেন রাজ্য জনগণের নেতা । রাজ্য সরকারের সাফল্য , জনপ্রিয়তা বহুলাংশে মুখ্যমন্ত্রীর উপর নির্ভরশীল । রাজ্য জনগণের আশা - আকাঙ্ক্ষা , ইচ্ছা - অনিচ্ছা পূরণ মুখ্যমন্ত্রীর কর্মসূচী দ্বারাই নির্ধারিত হয় । তাঁর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা রাজ্য জনগণের প্রধান আলোচ্য বিষয় ।
পদমর্যাদা : সংসদীয় শাসন কাঠামোয় ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলির প্রকৃত শাসক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা নিঃসন্দেহে বেশ গুরুত্বপূর্ণ । আবার অঙ্গরাজ্যের নিয়মতান্ত্রিক শাসক রাজ্যপাল বাস্তবে কেন্দ্রের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে । ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রের প্রাধান্য সর্বাধিক । ভারতীয় সংবিধানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতি , প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ মেনে নিতে বাধ্য থাকবে । কিন্তু সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ভারতীয় সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি রাজ্যপাল , রাজ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শ মেনে নিতে বাধ্য । তাই বলা যায় কোনো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কিছুটা অনুরূপ হলেও মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর মতো অতটাও ক্ষমতাশালী শাসক নন ।