1813 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন সম্পর্কে লেখ? এই আইনের সীমাবদ্ধতা,গুরত্ব বা তাৎপর্য লেখো?

ভূমিকা (Introduction)

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর সারা ভারতে অরাজকতা, অনিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে সমাজজীবনসহ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় প্রবল অবক্ষয় দেখা দেয়। পলাশীর যুদ্ধ (1757 খ্রি.) এবং পরে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানি লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

1765 খ্রিস্টাব্দের পর কোম্পানির শাসনমণ্ডলী ধর্ম, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে তুলনামূলক উদার নীতি অনুসরণ করতে থাকে। এই ভাবধারার ফলে আধুনিক ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং 1757 থেকে 1813 সালের মধ্যে কয়েকটি নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

1813 সালের সনদ আইন

কলিকাতা মাদ্রাসা, এশিয়াটিক সোসাইটি, সংস্কৃত কলেজ ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা

ওয়ারেন হেস্টিংস 1781 সালে ফারসি ভাষা ও ইসলামীয় শিক্ষা উন্নয়নে কলিকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

1784 সালে উইলিয়াম জোন্সের উদ্যোগে প্রাচ্যবিদ্যার গবেষণাকেন্দ্র হিসাবে এশিয়াটিক সোসাইটি গড়ে ওঠে।

1791 সালে জনাথন ডানকান বারাণসীতে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

1800 সালের নভেম্বর মাসে লর্ড ওয়েলেসলি ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্মীদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

এসব উদ্যোগ সরকার সমর্থন করলেও শিক্ষাব্যবস্থার কোনো নির্দিষ্ট সরকারি নীতি তখনও গৃহীত হয়নি।

লর্ড মিন্টোর উদ্যোগ

প্রাচ্য শিক্ষাবিস্তারে কোম্পানির দীর্ঘ উদাসীনতা ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠছিল।

1811 সালে লর্ড মিন্টো সতর্ক করেন যে, শিক্ষায় সরকারি ব্যয় না বাড়ালে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা পুরোপুরি লোপ পাবে। খ্রিস্টান মিশনারিরাও ইংল্যান্ডে ও ভারতে কোম্পানির এই উদাসীনতার তীব্র সমালোচনা করেন।

1813 সালের সনদ আইনের শিক্ষামূলক ধারা

প্রতি ২০ বছর অন্তর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদ নবায়ন করতে হতো। 1813 সালে সনদ নবায়নের সময় প্রবল জনমতের চাপে সনদের 43 নম্বর ধারায় শিক্ষাবিস্তার নিয়ে বিশেষ শর্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এই ধারার দুটি অংশ—

1. ভারতে সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ও উন্নতি এবং পণ্ডিতদের উৎসাহ দেওয়া।

2. দেশবাসীর মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রচারে কোম্পানিকে প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে হবে।

মিশনারি সম্পর্কিত ধারা

সনদ আইনে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল — ব্রিটিশ মিশনারিদের ভারতপ্রবেশ ও কার্যক্রমের বাধা দূর করা।

যদিও সরাসরি “মিশনারি” শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, তবে ধারাটি তাদের ধর্মপ্রচার ও শিক্ষাবিস্তারের বৈধ অনুমোদন দেয়। এর ফলে তারা নারীশিক্ষা, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং অনাথাশ্রম স্থাপনে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন।

সনদ আইনের গুরুত্ব, মূল্য ও তাৎপর্য

১) মিশনারিদের স্বাধীনতা

মিশনারিরা শিক্ষা ও ধর্মপ্রচারে স্বাধীনতা পান এবং দেশে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার ত্বরান্বিত হয়।

২) শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের স্বীকৃতি

প্রথমবারের মতো স্বীকার করা হয় যে ভারতীয়দের শিক্ষাদান সরকারের (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির) দায়িত্ব।

৩) শিক্ষাবিস্তারে প্রথম সরকারি পদক্ষেপ

এর আগে শিক্ষায় সরকারিভাবে কোনো অর্থ বরাদ্দ ছিল না। 1813 সালের আইন প্রথমবার শিক্ষাবিস্তারে সরকারি হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করে।

৪) ১ লক্ষ টাকার অর্থবরাদ্দ

ভারতীয় শিক্ষাবিস্তারে প্রতিবছর ১ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। যদিও এর ব্যবহার পদ্ধতি অস্পষ্ট থাকায় দীর্ঘ বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

৫) এক যুগের অবসান ও নতুন যুগের সূচনা

গ্রান্ট ও উইলবারফোর্সের আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং শিক্ষা প্রদানকে কোম্পানির বাধ্যতামূলক দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

৬) আধুনিক শিক্ষার ভিত্তি প্রস্তর

1813 সালের সনদ আইন আধুনিক ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার একটি মাইলফলক।

৭) ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার বীজ

এই আইন থেকেই সরকারি শিক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা প্রবেশ করে, যা স্বাধীন ভারতেও বজায় আছে।

৮) পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার

পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে আইনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৯) বেসরকারি উদ্যোগকে স্বীকৃতি

শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ দুই-ই সমান্তরালে চলার ভিত্তি সৃষ্টি হয়।

১০) অনুদান প্রথার সূচনা

এই আইনেই প্রথমবার ভারতীয় শিক্ষায় সরকারি অনুদান বা “গ্রান্ট” চালু হয়।

১১) ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধি

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে ভাষা হিসেবে ইংরেজি সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে।

1813 সালের শিক্ষাধারার সীমাবদ্ধতা

১) ‘সাহিত্য’ শব্দ নিয়ে বিভ্রান্তি

সাহিত্য বলতে ভারতীয় সাহিত্য নাকি পাশ্চাত্য সাহিত্য—এটি স্পষ্ট ছিল না।

২) ‘বিজ্ঞান’ কোনটি—প্রাচ্য না পাশ্চাত্য?

বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তন বলা হলেও কোন বিজ্ঞান বোঝানো হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি।

৩) নীতির অভাব ও অস্পষ্ট ব্যয় নির্দেশনা

শিক্ষা নিয়ে কোনো সর্বভারতীয় নীতি করা হয়নি। বরাদ্দ অর্থ ব্যয়ের ধারা এতটাই অস্পষ্ট ছিল যে পরবর্তী ৫০ বছর ধরেই বিতর্ক চলতে থাকে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন
পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন
comment url