উডের ডেসপ্যাচ এর সুপারিশ, গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা গুলি লেখো?
ভূমিকা
1813 সালের সনদ আইনের পর ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় নীতি, মতবাদ ও পদ্ধতি নিয়ে নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছিল। প্রায় চার দশক এই অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকার পর এক কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির প্রয়োজন দেখা দেয়। 1853 সালে কোম্পানির সনদ নবীকরণের সময় বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই প্রেক্ষিতে 1854 সালে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি স্যার চার্লস উডের তত্ত্বাবধানে যে দীর্ঘ ও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাদলিল প্রকাশিত হয়, তাই ইতিহাসখ্যাত “উডের ডেসপ্যাচ” নামে পরিচিত। ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা পরবর্তীকালে এর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হওয়ায় একে শিক্ষাক্ষেত্রে ‘এক যুগ-নির্দেশক দলিল’ বলা হয়।
উডের ডেসপ্যাচের প্রধান সুপারিশ
1. শিক্ষাবিভাগ প্রতিষ্ঠা
বাংলা, মাদ্রাজ, উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবে পৃথক শিক্ষাবিভাগ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রতিটি বিভাগের প্রধান হবেন ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (DPI)। তাঁর অধীনে বিদ্যালয় পরিদর্শকরা বিদ্যালয় পরিদর্শন, পরামর্শ প্রদান এবং সরকারের কাছে বার্ষিক রিপোর্ট দাখিল করবেন।
2. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
কলিকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।পরিচালনা করবে চ্যান্সেলর, ভাইস-চ্যান্সেলর ও সরকারের মনোনীত সদস্যদের সিনেট পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, ডিগ্রি/ডিপ্লোমা প্রদান ও অধ্যাপক নিয়োগ।অনার্স স্তরের শিক্ষা চালুর নির্দেশ দেন।
3. প্রাথমিক শিক্ষা
মেকলের “চুঁইয়ে পড়া নীতি” পরিত্যাগ করে দেশীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষা ও জীবনোপযোগী পাঠ্যসূচির ওপর জোর দেওয়া হয়।
4. অনুদান ব্যবস্থা (Grant-in-Aid)
বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিকে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে সরকারি অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। যেমন পর্যাপ্ত ভবন, শিক্ষাদানের উপযুক্ত ব্যবস্থা, নির্দিষ্ট ছাত্রসংখ্যা
এ ব্যবস্থা পরবর্তীকালে শিক্ষাবিস্তারকে আরও দ্রুত করে তোলে।
5. শিক্ষক-শিক্ষণ ব্যবস্থা
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য পৃথক শিক্ষক-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়। শিক্ষকশিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিরও সুপারিশ করা হয়।
6. জনশিক্ষা বিস্তার
দীর্ঘদিন সরকারের অবহেলায় জনশিক্ষা পিছিয়ে পড়েছে—এ কথা স্বীকার করে প্রতিটি জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষার ওপর অতিরিক্ত মনোযোগের নিন্দা করে গণশিক্ষার বিকাশে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে ডেসপ্যাচে উল্লেখ করা হয়।
7. নারীশিক্ষা
নারীদের শিক্ষার দ্রুত উন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বালিকাদের জন্য পৃথক বিদ্যালয়, পৃথক পাঠ্যসূচি এবং Grant-in-Aid ব্যবস্থার মাধ্যমে নারীশিক্ষা বিস্তারের সুপারিশ করা হয়।
8. বৃত্তিমূলক শিক্ষা
সাহিত্য ও দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রযুক্তি, চিকিৎসা, আইন, কারিগরি বিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়। শিক্ষাকে চাকরি ও কর্মমুখী করার ওপর জোর দেওয়া হয়।
9. ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা
ভারতের বহুধর্মীয় বাস্তবতায় সরকারি বিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চালুর নির্দেশ দেওয়া হয়। বেসরকারি বিদ্যালয় ধর্মীয় শিক্ষা দিলে সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করবে না।
10. মুসলিম শিক্ষা
মুসলিম জনগোষ্ঠীর গুরুত্ব বিবেচনায় তাদের শিক্ষায় বিশেষ উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় তাদের আগ্রহ তৈরি করা ও অনুদান প্রদান করার সুপারিশ করা হয়।
উডের ডেসপ্যাচের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও অবদান
১৮৫৪ সালের উডের ডেসপ্যাচ ভারতবর্ষের শিক্ষার ইতিহাসে এক মাইলফলক। আধুনিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত ও পূর্ণাঙ্গ কাঠামো এখানেই প্রথম প্রস্তাবিত হয়। এর তাৎপর্য ও অবদান নিম্নরূপ—
১. শিক্ষানীতির স্পষ্ট ঘোষণা
এই ডেসপ্যাচেই প্রথম ইংরেজ সরকার তাদের শিক্ষানীতি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে। যদিও সম্পূর্ণ সরকারি দায়িত্ব স্বীকৃত হয়নি, তবু শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের কর্তব্য পরিষ্কারভাবে নির্ধারিত হয়েছিল। একই সঙ্গে শিক্ষার উদ্দেশ্যও প্রথম নির্দিষ্ট করা হয়।
২. সর্বস্তরের শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা
উডের ডেসপ্যাচ প্রাথমিক, মাধ্যমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়— সব স্তরের শিক্ষার জন্য সংগঠিত পরিকল্পনা ও সুপারিশ প্রদান করেছিল।
৩. ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’র অবসান
মেকলের ‘Downward Filtration Theory’ বা চুঁইয়ে পড়া নীতি সমালোচনা করা হয়, কারণ এতে গণশিক্ষা উপেক্ষিত ছিল। উডের ডেসপ্যাচ গণশিক্ষার বিস্তার ও দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষাকে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
৪. মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব
ডেসপ্যাচে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। ইংরেজির পাশাপাশি দেশীয় ভাষাগুলির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
৫. রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন
বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাকে একত্রিত করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে একটি রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পথ তৈরি হয়।
৬. উচ্চশিক্ষায় সুযোগ বৃদ্ধি
মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা চালু করা হয়, যার ফলে উচ্চশিক্ষার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত হয়।
৭. নতুন শিক্ষামূলক উদ্যোগ
নারীশিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক খাতে উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশ ছিল, যা ভারতীয় শিক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে।
৮. ব্যাপক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা
সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে একটি ব্যাপক ও সংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তাই ইতিহাসবিদ জেমস মন্তব্য করেন—
“উডের ডেসপ্যাচে ভারতের পূর্ববর্তী শিক্ষাচেষ্টা পরিণতি লাভ করে।”
উডের ডেসপ্যাচের সীমাবদ্ধতা
যদিও ডেসপ্যাচটি যুগান্তকারী ছিল, তবুও কিছু স্পষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়ে যায়—
১. ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার অভাব
ডেসপ্যাচে ভারতীয় সমাজের বাস্তব চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়নি। অর্থাৎ, নীতি ছিল উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির।
২. জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অনুপস্থিতি
ডেসপ্যাচে জাতীয় ঐতিহ্য, স্বার্থ বা ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের ভিত্তিতে কোনো জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয়নি। তাই এটিকে জাতীয় শিক্ষানীতি বলা যায় না।
৩. দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে ব্যর্থতা
ভারতের দেশীয় শিক্ষা-পদ্ধতি, পাঠশালা, টোল বা মাদ্রাসাগুলির শক্তি, বৈশিষ্ট্য ও সম্ভাবনা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। বরং সেগুলিকে পাশ কাটিয়ে নতুন ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
(iv) গণউদ্যোগ স্তিমিত:
কেন্দ্রীভূত শিক্ষা প্রশাসনযন্ত্র রচনা করার ফলে উডের ডেসপ্যাচে শিক্ষায় গণউদ্যোগ অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।
(v) জাতীয় শিক্ষা ও সংহতির ধারাকে উপেক্ষা :
(vi) শিক্ষাগত ও জনসমাজের স্বার্থ অরক্ষিত:
উডের ডেসপ্যাচে ভারতীয়দের শিক্ষাগত স্বার্থ এবং জনসমাজের প্রকৃত স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে রক্ষিত হয়নি। একটি গোষ্ঠীবিশেষের সংকীর্ণ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য পরিকল্পিত হয়েছিল।
