উডের ডেসপ্যাচের প্রধান সুপারিশ গুলি লেখো? ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় উডের ডেসপ্যাচের প্রভাব আলোচনা করো।

 উডের ডেসপ্যাচের প্রধান সুপারিশ

1. শিক্ষাবিভাগ প্রতিষ্ঠা

বাংলা, মাদ্রাজ, উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবে পৃথক শিক্ষাবিভাগ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রতিটি বিভাগের প্রধান হবেন ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (DPI)। তাঁর অধীনে বিদ্যালয় পরিদর্শকরা বিদ্যালয় পরিদর্শন, পরামর্শ প্রদান এবং সরকারের কাছে বার্ষিক রিপোর্ট দাখিল করবেন।

2. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা

কলিকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।পরিচালনা করবে চ্যান্সেলর, ভাইস-চ্যান্সেলর ও সরকারের মনোনীত সদস্যদের সিনেট পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, ডিগ্রি/ডিপ্লোমা প্রদান ও অধ্যাপক নিয়োগ।অনার্স স্তরের শিক্ষা চালুর নির্দেশ দেন।

উডের ডেসপ্যাচের প্রভাব গুলি আলোচনা কর

3. প্রাথমিক শিক্ষা

মেকলের “চুঁইয়ে পড়া নীতি” পরিত্যাগ করে দেশীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষা ও জীবনোপযোগী পাঠ্যসূচির ওপর জোর দেওয়া হয়।

4. অনুদান ব্যবস্থা (Grant-in-Aid)

বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিকে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে সরকারি অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। যেমন পর্যাপ্ত ভবন, শিক্ষাদানের উপযুক্ত ব্যবস্থা, নির্দিষ্ট ছাত্রসংখ্যা

এ ব্যবস্থা পরবর্তীকালে শিক্ষাবিস্তারকে আরও দ্রুত করে তোলে।

5. শিক্ষক-শিক্ষণ ব্যবস্থা

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য পৃথক শিক্ষক-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়। শিক্ষকশিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিরও সুপারিশ করা হয়।

6. জনশিক্ষা বিস্তার

দীর্ঘদিন সরকারের অবহেলায় জনশিক্ষা পিছিয়ে পড়েছে—এ কথা স্বীকার করে প্রতিটি জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষার ওপর অতিরিক্ত মনোযোগের নিন্দা করে গণশিক্ষার বিকাশে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে ডেসপ্যাচে উল্লেখ করা হয়।

7. নারীশিক্ষা

নারীদের শিক্ষার দ্রুত উন্নয়নকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বালিকাদের জন্য পৃথক বিদ্যালয়, পৃথক পাঠ্যসূচি এবং Grant-in-Aid ব্যবস্থার মাধ্যমে নারীশিক্ষা বিস্তারের সুপারিশ করা হয়।

8. বৃত্তিমূলক শিক্ষা

সাহিত্য ও দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রযুক্তি, চিকিৎসা, আইন, কারিগরি বিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়। শিক্ষাকে চাকরি ও কর্মমুখী করার ওপর জোর দেওয়া হয়।

9. ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা

ভারতের বহুধর্মীয় বাস্তবতায় সরকারি বিদ্যালয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চালুর নির্দেশ দেওয়া হয়। বেসরকারি বিদ্যালয় ধর্মীয় শিক্ষা দিলে সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করবে না।

10. মুসলিম শিক্ষা

মুসলিম জনগোষ্ঠীর গুরুত্ব বিবেচনায় তাদের শিক্ষায় বিশেষ উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় তাদের আগ্রহ তৈরি করা ও অনুদান প্রদান করার সুপারিশ করা হয়।

ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় উডের ডেসপ্যাচের প্রভাব (Impact of Wood’s Dispatch on Indian Education System)

1854 খ্রিস্টাব্দের উডের ডেসপ্যাচ ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে এবং ভারতের শিক্ষা সংগঠনে একটি নতুন যুগের সূচনা ঘটায়। বহু মতভেদ, বিতর্ক ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে উডের ডেসপ্যাচ একটি সুসংহত, বলিষ্ঠ ও দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষানীতির ভিত্তি স্থাপন করে। প্রায় অর্ধশতাব্দী এই নীতি ভারতের শিক্ষাকে পরিচালিত করেছে এবং প্রায় এক শতাব্দীকাল স্থায়ী ব্রিটিশ শাসনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে।

উডের ডেসপ্যাচের প্রভাবসমূহ —

1. পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ সীমিতকরণ

পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষার জোরালো প্রবর্তনে শিক্ষকদের সৃজনশীলতা, স্বাধীনতা ও নতুনভাবে শিক্ষাদানের সুযোগ ব্যাহত হয়।

2. বৃত্তিমূলক ও শিল্পশিক্ষার সংকোচন

উচ্চশিক্ষার দিকে অতিরিক্ত ঝোঁকের ফলে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

3. ইংরেজি ভাষার আধিপত্য

মাতৃভাষার গুরুত্ব স্বীকার করা হলেও বাস্তবে ইংরেজি ভাষা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাধান্য লাভ করে।

4. কেরানি তৈরির প্রবণতা বৃদ্ধি

পুথিগত সাধারণ শিক্ষায় জোর দেওয়ায় মেধার সৃজনশীল বিকাশ ব্যাহত হয়ে কেরানিমুখী শিক্ষার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

5. শিক্ষার ব্যয়ের দায়ভার বৃদ্ধি

সরকারি সহায়তার বদলে বেসরকারি উদ্যোগ ও ছাত্রবেতনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় শিক্ষার ব্যয়ভার সাধারণ মানুষের ওপর বর্তায়।

6. দ্বৈত কর্তৃত্বের সৃষ্টি

শিক্ষা প্রশাসনে সরকারি শিক্ষাবিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়—এই দুই কর্তৃপক্ষের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আজও বিভিন্ন রূপে চলমান।

7. সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও অংশীদারিত্ব

গ্র্যান্ট-ইন-এড ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকারি তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের যে ধারা শুরু হয়, তার প্রভাব এখনও বিদ্যমান।

8. ইংরেজি প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা

ইংরেজি ভাষা আদালত ও প্রশাসনের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে স্বদেশি আন্দোলন থেকে স্বাধীন ভারতেও ভাষা-আন্দোলনের সূত্রপাত এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করেই।

9. জাতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে অসামঞ্জস্য

উডের ডেসপ্যাচের শিক্ষানীতি ছিল ভারতীয় ঐতিহ্য ও জাতির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অনেকাংশে অসঙ্গত। ফলে এর বিরুদ্ধে জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের জন্ম হয়।

10. সমদৃষ্টি নীতি

সরকারি নীতিতে সব ধরনের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি সমদৃষ্টি প্রয়োগের কথা উল্লেখ করা হয়, যা পরবর্তীতে শিক্ষাবিস্তারে ভূমিকা রাখে।

উডের ডেসপ্যাচের অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি অবদান

  • প্রতিটি প্রদেশে আলাদা শিক্ষাবিভাগ গঠনের নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়।
  • গ্র্যান্ট-ইন-এড ব্যবস্থার মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
  • ভারতে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রেরণা আসে এ ডেসপ্যাচ থেকেই; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাঠামো লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে তৈরি হয়।
  • নারীশিক্ষা, মুসলিম শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও জনশিক্ষা প্রসারের সুপারিশ ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
  • মাতৃভাষায় শিক্ষার নির্দেশ যথাযথভাবে অনুসৃত না হলেও তার নীতি ছিল শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

কার্জন যদিও শিক্ষাক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন আনেন, তবুও উডের ডেসপ্যাচের মূল কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে। ফলে উডের ডেসপ্যাচই ভারতীয় আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার:

উডের ডেসপ্যাচ ছিল ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম সুস্পষ্ট ও সুসংগঠিত নীতিদলিল। বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষা, নারীশিক্ষা, জনশিক্ষা, Grant-in-Aid প্রথা ও আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি—সবকিছুর ভিত্তি স্থাপিত হয় এই ডেসপ্যাচের মাধ্যমে। এজন্য একে ভারতীয় শিক্ষার “ম্যাগনা কার্টা”ও বলা হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন
পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন
comment url